চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বেশ সাড়ম্বরেই এই দুটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হিসেবে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেন। অন্যদিকে, নতুন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারকে আহ্বায়ক ও জাহিদ হাসানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। নতুন এই দুই দলে জায়গা পেয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ২১ তরুণ তুর্কী যারা ছাত্রনেতা হিসেবে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা।
এনসিপিতে স্থান পেলেন চট্টগ্রামের ১১ জন
এনসিপির শীর্ষ ১০ নেতার তালিকায় রয়েছেন বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের এক অগ্নিকন্যা। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব হিসেবে শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছেন ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং এলাকার তরুণী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদা সারওয়ার নিভা। আওয়ামী পরিবারে বেড়ে উঠলেও স্বৈরাচারবিরোধী প্রায় সব আন্দোলনে একেবারে সামনের সারিতেই ছিলেন নিভা। তিনি ছাড়াও এনসিপির ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে চট্টগ্রামের আরও অন্তত ১০ তরুণ-তরুণী স্থান পেয়েছেন।
তাদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পেয়েছেন তাজনুভা জাবীন এবং ছাত্রনেতা সৈয়দ হাসান আলী। চিকিৎসক ও অভিনেত্রী তাজনুভার গ্রামের বাড়ি ফতেয়াবাদে। আর সৈয়দ হাসান আলী নগরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। যুগ্ম সদস্য সচিব পদে মিরসরাইয়ের সাগুফতা বুশরা মিশমা, মহানগরীর এস এম সুজা উদ্দিন ও মীর আরশাদুল হক দায়িত্ব পেয়েছেন। সাতকানিয়ার জোবায়ের আরিফ যুগ্ম মুখ্য সংগঠক পদে এবং ইমন সৈয়দ দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
এর বাইরে সংগঠক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসেল আহমেদ এবং সদস্য পদে মহসীন কলেজের নীলা আফরোজ ও জাওয়াদুল করিম দায়িত্ব পেয়েছেন। জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব সাগুফতা বুশরা মিশমা বলেন, চট্টগ্রাম থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া প্রায় সবাই জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। তাদের সবাই আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিলেন। তবে রাসেল নাগরিক কমিটিতে ছিলেন না, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে স্থান পেলেন চট্টগ্রামের ১০ তরুণ
অন্যদিকে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ২০৫ সদস্যের কমিটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলার অন্তত ১০ তরুণ দায়িত্ব পেয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ পদ ‘জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব’ হিসেবে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষার্থী আল মাসনুন। বাকী ৯ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খান তালাত মাহমুদ রাফি ও মাহফুজুর রহমানকে যুগ্ম আহ্বায়ক, মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী এজিএম বাপ্পী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজাউর রহমান ও হাটহাজারী মাদ্রাসার আবরার কাউসারকে যুগ্ম সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এর বাইরে চট্টগ্রাম কলেজের মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরএম রাশিদুল হক দিনারকে সংগঠক এবং সিটি কলেজের মোহাম্মদ সালেহ মাসুম ও পটিয়া মাদ্রাসার নাহিন শিকদারকে সদস্য করা হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমন্বয় করেছিলেন। পরবর্তীতে গঠিত আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্বে ছিলেন রিজাউর রহমানসহ কয়েকজন। অবশ্য বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কমিটি ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন রিজাউর রহমান। তার জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক সমন্বয়ক আরিফ মঈনুদ্দিনকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের যুগ্ম সদস্য সচিব রিজাউর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত করতেই নতুন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন এই ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে আমরা শিক্ষা, ঐক্য ও শিক্ষার্থীদের মুক্তির কথা বলতে চাই।
আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব এজিএম বাপ্পী বলেন, আমরা চিরাচরিত লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিলোপ ঘটিয়ে দেশে নতুন ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রচলন করতে চাই। চাটুকারিতা বাদ দিয়ে সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির প্রচলন করতে চাই।
‘ভাই হত্যা’ নাড়িয়ে দিয়েছিল রাজনীতিবিমুখ নিভাকে
জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষ দশ পদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ছোটবোন। তার পরিবারের আরও একাধিক সদস্য আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
তবে নিভার বড় বোন জুবাইদা সরোয়ার নিপা বলেন, নিভা আমাদের পরিবারে সবচেয়ে মেধাবী ছিল। তার সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল দিয়াজের। দিয়াজই তাকে গাইড করত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিল সে। কিন্তু ২০১৬ সালে দিয়াজের মৃত্যু তার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। দিয়াজ হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে চট্টগ্রামের এক শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ও রাজনীতির কালো দিকটা সে দেখেছে। এমনিতেই সে রাজনীতি বিমুখ ছিল, দিয়াজ হত্যার পর বাসায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতো। আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমাদের নানা যুক্তি দেখাতো, আমরা তার সঙ্গে পেরে উঠতাম না। এরমধ্যে আমাদের ছোটভাই মিরাজ ইরফান চৌধুরীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ২০১৯ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অনেকটা সামনের সারিতে ছিল নিভা। এসব দেখে মিরাজ আমাদের জানায়। তখন আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। সে আমাদের রাজনীতি ত্যাগ করার কথা বলতো। মিরাজ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করায় তার ওপরও বিরক্ত ছিল নিভা। ধীরে ধীরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয় সে।
তিনি জানান, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জড়ানোর বিষয়টি জানতে পারায় পরিবার তাকে কৌশলে চট্টগ্রামে এনে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন কাউকে না বলে ঢাকায় চলে যান নিভা। ২০২০ সালের নভেম্বরে নানার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি আসলেও সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ফিরে যান। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরমধ্যে একদিন তার মা ও বোনজামাই ঢাকায় গিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। সেসময় দীর্ঘক্ষণ খোঁজাখুজির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে তাকে খুঁজে পান তারা। তবে সেসময় মা ও বোনজামাইকে দেখে বেশ বিরক্ত হন নিভা। পরে বাসাও পরিবর্তন করে ফেলেন। এরমধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জড়ানোর
বিষয়টি ছোটভাই মিরাজের মাধ্যমে জানতে পারে পরিবার। দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় বিষয়টি স্বাভাবিক হিসেবেই নিয়েছিল পরিবার। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি টিভিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পদে নিভার নাম দেখে অবাক হন পরিবারের সবাই। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে নাহিদা সারওয়ার নিভার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।
সূত্র: পূর্বকোণ
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ