চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দলীয় সাংবাদিক হবেন না, দেশের সাংবাদিক হোন, মানবিক সাংবাদিকতা চাই। এটাই হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে “সাংবাদিক ছাত্র জনতার সমাবেশে” প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতার নামে যারা স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়ায়, তারা আসলে সাংবাদিক না। তারা প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ব্যক্তির পক্ষে, একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয়—তারা সাংবাদিকতার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তারা হয়ে গেছে দলীয় কর্মী। এই জিনিসগুলো আপনাদের অনুধাবন করতে হবে। আমাদের যেন তাদের মতো চলতে না হয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
এর আগে তিনি প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত “ক্যামেরায় জুলাই বিপ্লব শীর্ষক প্রদর্শনী” ঘুরে দেখেন। অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনের উপর বিভিন্ন শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে বৈশাখী টিভির ব্যুরো চিফ গোলাম মওলা মুরাদ ও মিয়া মোহাম্মদ আরিফের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।
আমীর খসরু বলেন, আমরা ১৫ বছর ধরে সাংবাদিকতার চিত্র সম্মুখভাবে দেখেছি। কারণ আমরা সম্মুখভাগে ছিলাম। আমি সার্বিকভাবে যেভাবে ছিলাম, সাংবাদিকতার চিত্র পরিষ্কারভাবে দেখেছি। কারা নিজের দেশকে বিক্রি করে সাংবাদিকতা করেছে, কারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের সঙ্গে থেকে সুবিধা ভোগ করেছে। সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করেছে, সব দেখেছি।
শেখ হাসিনার সময়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা তুলে ধরে আমীর খসরু বলেন, শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্স শেষে যে সাংবাদিকরা জনগণের কথা তুলে না ধরে স্বৈরাচারের কথা তুলে ধরেছে, তারা কি কোনো সাংবাদিক? তারা তো সাংবাদিকতার মানসম্মান নষ্ট করেছে।
তিনি আরও বলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে তারেক রহমান সাহেবকে বিদ্রুপ করে একটা কার্টুন ছাপানো হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এই সাংবাদিক বিপদে পড়বে। কিন্তু হলো উল্টো—তারেক রহমান সাহেব স্ট্যাটাস দিলেন, ‘আমরা দেড় দশক ধরে যুদ্ধ করছি—এই সাংবাদিকরা যাতে তাদের এ কাজগুলো করতে পারে। এই কথার মধ্যেই সব মেসেজ চলে এসেছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আমরা সত্যিকারের সাংবাদিকতা চাই, নিরপেক্ষতা চাই। সাংবাদিকদের পেশাগত মানদণ্ড অক্ষুন্ন রাখতে হবে। এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের শপথ। আগামীতে সাংবাদিকরা যদি জনগণের কথা তুলে ধরতে পারে, স্বাধীনতার কথা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার তুলে ধরতে পারে—তাহলেই হবে সফল সাংবাদিকতা।
শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমীর খসরু জেলে থাকার কথা তুলে ধরে বলেন, আমি কিন্তু আজকের এই দিনে গত বছরে জেলে ছিলাম—যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাচ্ছিলেন। জেলের ভেতরে জানতে পারলাম, সেনাবাহিনীর প্রধান তখন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। জেলখানায় আমাদের কাছে তো কোনো সংবাদ থাকে না। কিছু কিছু লোক রুমে রেডিও চালাই—ওটা তার বন্দোবস্তের মাধ্যমে। তো একজন এসে বলল, এটা শুনতে হবে, সেনাবাহিনীর প্রধান বক্তব্য রাখছেন। তখনই মনে হলো শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, পদত্যাগ করেছেন।
কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে আমীর খসরু বলেন, আগে তো অনেকবার জেলে গিয়েছি, কিন্তু শেষবার অর্থাৎ গত বছর এই দিনে জেলে কাটানো সময় অনেক কঠিন ছিল। পাঁচটার সময় লকআপ, পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, বাইরে থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ—এই কঠিন অবস্থার মধ্যে একেকটা দিন কাটাচ্ছি। এই সময়ে যখন এ খবর এলো, তখনই আমরা ধরে নিয়েছি দেশ মনে হয় মুক্তির দিকে যাচ্ছে।
জেলের মধ্যে বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, যখন সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলেন, তখন সমস্ত জেলখানায় একসাথে অনেকটা বোমা ফেটেছে। মানে সবাই একসাথে আওয়াজ করে উঠেছে, যা অনেকটা বোমার মত। তখন আমরা কঠিন সময় পার করছিলাম। জেলার, জেল সুপার নেতৃত্বে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রুমে চলে এলো। তারা যখন এলো, তখন থেকে মনে হলো আমি জেলের মালিক হয়ে গেছি, আর তারা আমার অধীনস্থ হয়ে গেছে। তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি যেভাবে বলবো, জেলখানা সেভাবে চলবে।
জেল ভাঙার চেষ্টা চলছিল, তখন বন্দিদের ছাড়া তিনি বের হবেন না জানিয়ে ছিলেন উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, তখন জেলখানায় দশ হাজার লোক একসাথে ছিলাম। বেশিরভাগ বিএনপির নেতাকর্মী, ছাত্র, জনতা, অন্যান্য পেশার মানুষ। সবাই অন্যায়ভাবে জেলে, কেউ এক মিনিটও থাকতে চায় না। যখন শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তখন ওরা বলছে, ‘আমি এ মুহূর্তে বাড়ি যেতে চাই।’
জেল কিলিংয়ের মতো কিছু হয়ে যেতে পারে—এই ভয় ছিল উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, তবুও একটা জায়গায় জেল ব্রেক হয়েছে। আর্মি গিয়েছে, হেলিকপ্টার গিয়েছে, গোলাগুলিও হয়েছে। আমাদের ভয় ছিল—জেল কিলিংয়ের মতো শেখ হাসিনা আমাদের আবার শেষ করে দেবে কি না। সেখান থেকে আমরা কোনোভাবে মির্জা ফখরুল ইসলামের মাধ্যমে আর্মি চীফের সাথে যোগাযোগ করি। তখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আবুল হাশেম বক্কর বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। স্বৈরাচারী শাসক জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে তাদের স্বাধীনতা ও মৌলিক সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। জনগনের কাছ থেকে দেশের মালিকানা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রজা বানিয়ে রেখেছিল। কিন্ত বীরের জাতি একাত্তরের মতো রক্ত দিয়ে নিজেদের মালিকানা ফিরিয়ে এনেছে। জনরোষের ভয়ে খুনি হাসিনা ও তার দোসররা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আবু সুফিয়ান বলেন, বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোতে জনগণের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই তারেক রহমান ৩১ দফা দিয়েছে সবার সঙ্গে আলোচনা ভিত্তিতে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত ৩১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার রূপরেখা। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহকারী মহাসচিব মুস্তাফা নঈম, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ সভাপতি এড. ইফতেখার হোসেন চৌধুরী মহসিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, আহমেদুল আলম চৌধুরী রাসেল, সিএমইউজে’র সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শিল্পী, মহানগর মহিলাদলের সভাপতি মনোয়ারা বেগম মনি, সাংবাদিক কামরুল হুদা, হাসান মুকুল, ওয়াহিদ জামান, মোহাম্মদ আলী, জালাল উদ্দীন রুমি, জাহাঙ্গীর আলম, জোবায়ের চৌধুরী, ইভেন মীর, নুর হোসেন মামুন, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিদোয়ান সিদ্দিকী, সিয়াম এলাহী প্রমুখ।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ