সিপ্লাস ডেস্ক: ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক এখন সারা দেশে বিস্তৃত, যা গৃহস্থালি থেকে শুরু করে অফিস কিংবা ফিল্মিপাড়া পর্যন্ত কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। এডিস মশা নীরবে-নিভৃতে তার কাজ করে যাচ্ছে আর জিম্মি করছে সারা দেশের মানুষকে। গতকাল খবরে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে। এক দিনে রেকর্ড ৮২০ রোগী ভর্তি। শিশু নিয়ে আতঙ্কে অভিভাবকরা, এ পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যু। শহর ও গ্রামের হাসপাতালগুলিতে ক্রমশ চাপ বাড়ছে। অথচ রোগী ফেলে আন্দোলনে নেমেছে একশ্রেণির চিকিৎসক। গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু মোকাবিলার আয়োজন চোখে পড়ছে না। ময়মনসিংহে সাত দিনে দুই জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই পরিস্থিতিকে ‘জনস্বাস্থ্যসংকট‘ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটি ১৫ দফা সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশে ২০০১-০২ সালে প্রথম বার বিস্তৃতিভাবে ডেঙ্গ জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের উচ্চ হার লক্ষ করা যায় বর্ষাকালে শহর ও উপশহর এলাকার জনগোষ্ঠীতে। ২০২২ সালে সারা দেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন, এর বাইরে আরো অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছেন এবং অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তাদের হিসাব সরকারি খাতায় ওঠানোর সুযোগ নেই। অন্য দিকে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন, ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন, তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।
ডেঙ্গু জ্বর আমাদের কাছে অতিমারি না হলেও কোনো অংশে কম নয়, প্রতি বছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করছে। ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এ দেশে ডেঙ্গু প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। সাম্প্রতিক কালে স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলেও ডেঙ্গু কিংবা অন্য কোনো রোগের ওপর তেমন কোনো গবেষণার কাজ দেখা যায় না।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা হতে পারে, এই মর্মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সর্তকবার্তা দিলেও সিটি করপোরেশন তা আমলে নেননি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১২ সালেই একটি সর্তকবার্তা দিয়েছিল যে, বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ ডেঙ্গুঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কথা বিষেশভাবে উল্লিখিত ছিল। যাতে ছিল ডেঙ্গু বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় হলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন দেশ, তথা আক্রান্ত হয়েছে, এমন ৭৫ শতাংশের বসবাস এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। আরো জানা গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণের জন্য (Global strategy for dengo prevention and control) শিরোনামে বৈশ্বিক কৌশলপত্র প্রকাশ করেছিল। এর অংশ হিসাবে ডেঙ্গু জীবাণু বহনকারী মশা কীভাবে উৎপত্তি হয়, এর অবস্থানস্থল কোথায়, কখন কামড়ায়, কীভাবে রোগের লক্ষণ শুরু হয় এবং প্রতিকারের উপায় কী—এসব নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি আগাম বার্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেওয়া হয়েছিল।
এখন ঢাকার দুইটি সিটি করপোরেশন তাদের দায় স্বীকার করলেও ডেঙ্গু রোগের ব্যাপারে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নাতা, ওষুধ ছিটানো ইত্যাদির বিলম্বের কারণে বিষয়টি হুমকির মুখে রয়েছে, বিশেষত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকেন্দ্রিক সেবায়। আর জনমনে আতঙ্কের কথা বলাই বাহুল্য। এই ডেঙ্গু সারা দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি বিস্তারের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ডেঙ্গু নিরাময়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে উদাসীনতা খুবই প্রবল, যার প্রমাণ হলো—শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা জারি করতে হয়েছে, যাতে বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় হাইকোর্ট জানতে চায় নতুন ওষুধ আনতে আর কত বিলম্ব হবে ?’ দুটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে ডেঙ্গু নিয়ে। উত্তর বলছে, যে ওষুধ বাতিলকৃত, তা দক্ষিণে কিনে নির্বিঘ্নে ছড়ানো হচ্ছিল। আবার দক্ষিণ বলছিল আগামী অল্প দিনের মধ্যেই ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
চিকিত্সকরা বলছেন, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যদিও এখনো ডেঙ্গু জ্বরের কোনো প্রতিষেধক বের করতে পারেনি কেউ। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, সাধারণত জুন-জুলাই থেকে শুরু করে অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গু বিস্তার থাকে। সাধারণত মশকনিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দায়ী। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এখন এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যার সঙ্গে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই, এর মধ্যে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি রয়েছে।
এখন ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী? এ থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মুলের কোনো বিকল্প নেই, পানি জমতে পারে এমন কোনো অবস্থা যাতে তৈরি না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সব ধরনের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেও এগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকে সচেতন করা, জনসাধারণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা, মশা নিধনের জন্য মশানাশক ওষুধ ছিটানো, বাসা কিংবা অফিসের আর্বজনার স্থানে পানির ব্যবহার না করা ও সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালিত করা; ডেঙ্গু মশা নিধনকারী প্রতিষ্ঠানে বাজেটের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা ইত্যাদি। আরো একটি গুজব শোনা যায় যে, ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস নাকি বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে, যাতে মশা না কামড়ালেও ডেঙ্গু হতে পারে। এখন এই গুজরেব সত্যতা কতটুকু বা নিরসন করবে কে? যদি কোনো গবেষক না থাকে তবে প্রাধিকার ভিত্তিতে ডেঙ্গুর ওপর গবেষণা করার দাবি রইল। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা পরিকল্পনায় দেশের অগণিত চিকিৎসক যারা স্নাতকোত্তোর পর্যায়ে (এমএস/ এমডি/ এফসিপিস/পিএইডি) গবেষণারত তাদের ডেঙ্গু বিষয়টিকে গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবে বাছাই করা উচিত।
স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় জাতীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি, যেমন ডেঙ্গুর মতো বিষয়গুলো যখন ব্যাপকভাবে দেখা দেয়, তখন এর নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। স্বাস্থ্য বাজেট নিয়ে প্রায়শই সমালোচনা শোনা যায়, যা জাতীয় বাজেটের মাত্র দুই-তিন শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ (ওষুধ, যন্ত্রপাতি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা) ও স্বাস্থ্য গবেষণা/প্রশিক্ষণের খরচ মেটাতে হয়। তার মধ্যে আবার ডেঙ্গুজনিত রোগ, বন্যাজনিত রোগ, মৌসুমি রোগ ইত্যাদি মোকাবিলার জন্য তেমন কোনো বাজেট বরাদ্দ থাকে না। তা হলে স্বাস্থ্যসেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত ফি (যদিও সরকারি হাসপাতালে কম)-এর টাকা কি বাজেটের ঘাটতি পূরণে সহয়তা করে না? আমরা যদি স্বাস্থ্য বাজেটকে দেশের প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ভাগ করি, তাহলে মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৫১৩ টাকা এবং তা প্রতি মাসে পরে ১২৭ টাকা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ ১৮ দশমিক ০১ ডলার, যা ভারতে ৬২ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭২০ ডলার ও শ্রীলঙ্কায় ১ হাজার ডলার।
আমাদের স্বাস্থ্যনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা হবে মানবিক, নৈতিক, ব্যয়সাশ্রয়ী ও সমাজমুখী, যদিও কাজটি কঠিন তবুও সম্ভব। আর ডেঙ্গু রোগের মতো রোগ যাতে বারবার মানুষকে ভোগাতে না পারে, তার জন্য গবেষণা বরাদ্দ বাড়াতে হবে।