নিজস্ব প্রতিবেদক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার উত্তাল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিজয়ের আনন্দ উপভোগ ও একটি শৈল্পিক চট্টগ্রাম গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা সড়ক সংলগ্ন দেয়াল ফ্লাইওভারের পিলার রাঙিয়ে তুলেছিল গ্রাফিতির ছোঁয়ায়। জুলাই বিপ্লবে শহীদ ছাড়াও অংকিত গ্রাফিতিগুলোতে স্থান পেয়েছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি, রাষ্ট্র সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন উক্তি ও শ্লোগান। কিন্তু বিপ্লবের তিন মাস না পেরুতেই সেই হৃদয়ছোঁয়া বিজয়ের গ্রাফিতিগুলো ঢেকে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যানার পোস্টারে। বিনষ্ট হচ্ছে নগরীর শিল্প সৌন্দর্য। এসব ব্যানার, পোস্টার অপসারণ করে পরিচ্ছন্ন নগরী করা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব হলেও এ নিয়ে তেমন কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এতে ক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের পর বিজয়ের আনন্দের শিল্পরূপ দেয়ার প্রত্যয়ে শত শত শিক্ষার্থী পকেটের টাকায় রঙ, রঙতুলি, আঁকার সরঞ্জাম কিনে স্ব উদ্যোগে দেয়াল, ফ্লাইওভারের পিলার, রোড ডিভাইডার, রোড আইল্যান্ডসহ নানা স্থানে গ্রাফিতি এঁকেছিল। এসব গ্রাফিতিতে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমাজ-রাষ্ট্রের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাকস্বাধীনতা, সমঅধিকার, অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিবাদের জ্বালাময়ী উক্তি। কেউ কেউ দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেছিল আরবী ক্যালিওগ্রাফী। কোথাও ফুটে উঠেছিল বিজয়ের গান, কবিতা।
গ্রাফিতি সম্পর্কে গুগল উইকিপিডিয়া সার্চে জানা গেছে, গ্রাফিতি হল বিনা অনুমতিতে জনসাধারণের নানা অভিমত শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালের উপরে লেখনী কিংবা অঙ্কনের মাধ্যমে তুলে ধরা। বর্তমান সমাজের চেয়ে প্রাচীন সমাজের গ্রাফিতিগুলো আরো বেশি অর্থপূর্ণ এবং ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বহমান ছিল। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাতো। রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিস্থলের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান এবং উত্তর সৌদি আরবে শিলা ও পাথরের উপরে কিছু লেখা পাওয়া গিয়েছে স্যাফাইটিক ভাষায় এবং ধারণা করা হয় এই স্যাফাইটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকেই।
জুলাই বিপ্লবে অঙ্কিত গ্রাফিতি সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী মো. রাসেল জানান, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিবেদিত ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করি। তখন ঢাকাসহ সারা দেশেই গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা চট্টগ্রামের প্রধান সড়ক, উপসড়ক বা অলিগলি সংলগ্ন দেয়ালেও গ্রাফিতি আঁকি। বাবা-মার কাছ থেকে টাকা এনে গ্রাফিতির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আঁকা শুরু করেছিলাম।
তিনি বলেন, আমাদেরকে উৎসাহিত করতে সেসময় অনেক পেশাদার শিল্পীও আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে- গ্রাফিতিগুলোর উপর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ব্যানার, পোস্টার সাঁটানো হচ্ছে। নানা শ্রেণি পেশাজীবী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রচারণা পোস্টার সাঁটানো হচ্ছে। ব্যানার, পোস্টারে গ্রাফিতিগুলো আস্তে আস্তে ঢাকা পড়ছে।
শিক্ষার্থী জেবুন্নেসা বলেন, আমরা গ্রাফিতি শুধু যে দেয়াল বা ফ্লাইওভারের পিলারে এঁকেছি তা নয়। রাস্তায়ও আমরা স্ট্রিট পেইন্টিংও করেছি। নগরীর জাকির হোসেন সড়ক, নিউমার্কেট সড়কে দেখা যাবে আমাদের স্ট্রিট পেইন্টিংয়ের কাজ। আমরা কেউ পেইন্টার ছিলাম না। আঁকাআঁকিতে কারো তেমন ভালো হাতও ছিল না। শুধু আনন্দের আতিশয্যেই নতুন উদ্যমে আমরা এগুলো করেছিলাম। কিন্তু গ্রাফিতির এই অবস্থা দেখে খুব কষ্ট লাগে। যারা গ্রাফিতি ঢেকে ব্যানার পোস্টার সাঁটাচ্ছে তাদের কোন বোধদয় হচ্ছে না।
তবে জুলাই বিপ্লবের আনন্দে আঁকা গ্রাফিতিগুলোর ঢেকে যাওয়া প্রসঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি চাটগাঁ নিউজকে বলেন, ব্যানার পোস্টারগুলো দ্রুত অপসারণ করে ফেলা হবে। আগামী সপ্তাহেই ব্যানার পোস্টার অপসারণের কাজ শুরু হবে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মেয়র মহোদয়ের ছবি সম্বলিত যেসব ব্যানার পোস্টার টাঙ্গানো আছে সেগুলোও দ্রুত সময়ে অপসারণ করা হবে। এই ব্যাপারে মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনা রয়েছে।
চাটগাঁ নিউজ/ইউডি/এসএ