চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলায় দুই জামায়াতকর্মী ‘গণপিটুনিতে’ খুন হওয়া নিয়ে চলছে তোলপাড়। এরই মধ্যে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর সামনে এসেছে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য।
পুলিশ বলছে, ওই দুই জামায়াতকর্মীর রক্তাক্ত মরদেহের কাছে পাওয়া অস্ত্রটি ছিল ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন নগরীর কোতোয়ালী থানা হতে লুট হওয়া অস্ত্র। এছাড়া অতিসম্প্রতি দফায় দফায় সেই এলাকায় ওই দুজন গিয়েছিলেন অন্তত ৮ বার। নিহত নেজাম-ছালেক চাঁদার জন্য চড়-থাপ্পড়ও মেরেছিলেন এক ইউপি সদস্যের স্ত্রীকে। যার ফলে, খুনসহ একাধিক মামলার দুই আসামির প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল এলাকাবাসীর।
তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি, বিচার-সালিশের কথা বলে ডেকে নিয়ে এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রকাশ মানিকের লোকজন তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে।
যদিও পুলিশের দাবি— সেখানে বিশেষ দলের কোনো ব্যক্তি বা চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততা ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরকার পতনের পর দেশে আসা নেজাম ও ছালেকের কাছে থানা লুটের অস্ত্র কীভাবে গেল সেটিরও তদন্ত চলছে বলে জানায় পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) নগরীর দুই নম্বর গেটে জেলা পুলিশ কার্যালয়ে রাউজানের শুটকি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের সম্পর্কে তথ্য জানাতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।এসময় পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম সানতু এই বিষয়ে আলোকপাত করেন।
কোতোয়ালী থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ছিল নেজামের কাছে— এমনটা জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাতকানিয়ায় নিহত নেজাম ও ছালেকের লাশের পাশে যে অস্ত্র ছিল, এটি কোতোয়ালী থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র। নেজাম ঘটনার দিন গুলি করতে করতে অস্ত্রের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র কীভাবে তাদের কাছে গেল—বিষয়টি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এগুলো আমাদেরকে খুঁজতে হচ্ছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
এসপি বলেন, ‘ছালেকের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা রয়েছে, তার মধ্যে দুটি হত্যা। এছাড়া চুরি ও বিস্ফোরক আইনেও মামলা আছে। নেজামের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। তাদের গতিবিধি যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, বিগত তিন মাসে ওই এলাকায় তারা বিভিন্ন কাজে গিয়েছেন অন্তত ৮ বার। ঘটনার দিন তারা ৭টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা যোগে গিয়েছিলেন। ওখানে যারা দোকানদার ছিল তাদের কাছে অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন। এর ৪-৫ দিন আগেও চাঁদার জন্য সেখানকার এক ইউপি সদস্যের স্ত্রীকে থাপ্পড় মেরেছিলেন তারা। এর ফলে স্থানীয়দের মাঝে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়। তারা সেখানে চাঁদার জন্য যেতেন বলে আমরা তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি।’
হত্যাকাণ্ডে মানিক চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘একটা কথা উঠেছে, একটি বিশেষ দলের চেয়ারম্যান সেখানে ছিল কিনা। আসলে সেখানে বিশেষ দলের কোনো ব্যক্তি বা চেয়ারম্যানকে আমরা খুঁজে পাইনি কিংবা তাদের সম্পৃক্ততা কোথাও পাইনি। বরং নিষিদ্ধঘোষিত একটি ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের আমরা অবিরত খুঁজে যাচ্ছি। তাদেরকে ধরা আমাদের দায়িত্ব।’
এদিকে এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ মার্চ রাত ৯টার পর ৭টি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নেজাম ও ছালেকসহ ১০ থেকে ১২ জন এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকার একটি দোকানের সামনে নামেন। সেখানে গিয়ে তারা অস্ত্র প্রদর্শন করেন। তখনই নিকটস্থ একটি মসজিদে তারাবির নামাজ শেষ হয়েছিল। ওই মসজিদ থেকে মাইকে ‘ডাকাত আসছে ডাকাত আসছে’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় একাধিকবার।
একপর্যায়ে এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে নেজাম ও তার সহযোগীদের ঘিরে ফেলে। এ সময় নেজামের সহযোগীরা জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ সময় শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়। তবে ক্ষুব্ধ জনতার রোষ এড়িয়ে নেজামের সহযোগী জামশেদসহ অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু নেজাম ও ছালেককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের সক্রিয় কর্মী নেজাম উদ্দিন আওয়ামী লীগের আমলে দীর্ঘসময় এলাকা ছাড়া ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলাকায় ফেরেন। এরপর এলাকায় নেজামের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়। তারা এরই মধ্যে একাধিকবার সংঘাতেও জড়িয়েছে। নেজাম ও তার পক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠতে থাকে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই কাঞ্চনা এলাকা নেজাম উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মধ্যম কাঞ্চনা যায় রিফাতের হাতে। অন্যদিকে এওচিয়া এলাকা ভাগ করে নেন আবু তাহের আদাইয়া, জাহেদ ও ফরহাদ।
দুই জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এবং গ্রামবাসীর ওপর গুলি ছোঁড়ার ঘটনায় তিনদিন পেরোলেও এখনও হয়নি মামলা। তবে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র আইনে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ঘটনায় অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। এখানে দুটি গ্রুপ পেয়েছি। একটা হচ্ছে গ্রামবাসী যারা গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে কোনো মামলা হয়নি। যারা মারা গেছে তাদের পক্ষ হতেও কোনো মামলা হয়নি। যেহেতু আমরা পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছি, সেহেতু আইন অনুযায়ী আমরা অস্ত্র আইনে মামলা করেছি।’
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ/এসএ