জব্বারের বলীখেলার সেই জব্বারের ‘কবর’ কোথায় জানে না কেউ!

উজ্জ্বল দত্ত : চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য জব্বারের বলীখেলা। চাটগাঁবাসীর কাছে যা ‘‘জব্বইরগার বলীখেলা’’ নামে পরিচিত। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে যে খেলার খ্যাতি; সেই বলীখেলার উদ্ভাবক চট্টগ্রামের বকসিরহাট বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর। যে জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিতে তৎকালীন চট্টগ্রামের হাজার হাজার তরুণ-যুবক ‘বলী’ বা ‘কুস্তিগীর’ হতে শরীর গঠন করতেন। আবার তারাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হতেন। সে বলীখেলার প্রবর্তক আবদুল জব্বার সওদাগরের কবরটি কোথায় তা অনেকেরই অজানা।

তবে জব্বার সওদাগরের কবরটি কোথায়- তা অজানা থাকার কারণও রয়েছে। জানা যায়, আবদুল জব্বার সওদাগরের বাড়ি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন বকসির হাট ওয়ার্ডের বদরপাতি এলাকায়। উনিশ শতকের সময়কালে তিনি খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় প্রসারের কারণে তিনি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন। সেসময় বণিক সম্প্রদায় বা ব্যবসায়ীদেরকে চট্টগ্রামের মানুষ ‘সওদাগর বা সদঅর’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই সূত্রে আবদুল জব্বারকেও লোকজন ‘জব্বর সদঅর’ নামে ডাকতেন।

জানা গেছে, আবদুল জব্বারের কবর বদরপাতি এলাকাস্থ হয়রত শাহ আমানত (র.) ও হযরত বদর শাহ (র) মাজার সংলগ্ন এলাকায়। পারিবারিক কবরস্থানে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। তবে সেই কবরস্থানে আবদুল জব্বারের নামে কোন নামফলক নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে মহৎ এই ব্যক্তির কবরটি চিহ্নিতকরণ বা সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। ফলে খোদ পরিবারের নতুন প্রজন্মের সদস্যরা আবদুল জব্বারের কবর কোনটা বা নির্দিষ্ট জায়গাটা চিনেন না।

এ বিষয়ে বদরপাতি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিক কামরুজ্জামান রনি জানান, যে আবদুল জব্বার সওদাগরের নামে বলীখেলা। যার কর্মের বদৌলতে তাঁর পরিবার ঐতিহ্যবাহী এই বলীখেলার গৌরব বহন করে চলেছে। সেই মহান মানুষটির স্মৃতি সংরক্ষণে কোন উদ্যোগ নেই তাদের। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা ছোটবেলা থেকেই এ বলীখেলা ও মেলায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছি। বর্তমানে নানা ব্যস্ততায় হয়তো তা আর হয়ে উঠছে না। তবে আমাদের জীবনে মিশে আছে বলীখেলার নানা স্মৃতি।

তিনি বলেন, বদরপাতিতে আবদুল জব্বারের কবর আছে সত্যি। কিন্তু সেটি কেউ চিনবেন না। কারণ তার কবরে কোনো নামফলক নেই। পারিবারিকভাবে তার স্মৃতি সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য সমুন্নতকরণে আবদুল জব্বার সওদাগরের স্মৃতি সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

জব্বইরগার বলী খেলা

বলীখেলা মানে কুস্তি প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি খেলাকে বলীখেলা নামে ডাকা হয়। ১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নিতে শুরু করে। তখন তরুণ সমাজকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার একটা রাজনৈতিক চেতনা বাঙালিদের মনে দোলা দেয়।

এসময় আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলাটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরোক্ষ ইন্ধন হিসেবে কাজ করেছিল। তাঁর ধারণা ছিল, বলীখেলা হলে অত্র এলাকার তরুণ, যুবকরা এতে অনুপ্রাণিত হবে। সেই সাথে তাদের মাঝে শারীরিক অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হবে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিটি তরুণ-যুবক শারীরিকভাবে শক্ত সমর্থ হবে। আর এ তরুণদেরকে পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করানো। নিজের নামেই আবদুল জব্বার এই বলীখেলা প্রবর্তন করেছিলেন।

আবদুল জব্বারের চিন্তায় আরও একটি বিষয় ছিল, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। ওই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের হিন্দুদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণায় আবদুল জব্বার মুসলিম বিপ্লবী বাড়ানোর এ কৌশলটি বেছে নিয়েছিলেন। কারণ একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সরাসরি বিপ্লবে অংশগ্রহণ করা, অর্থ যোগানদাতা বা প্রত্যক্ষ কোন সমর্থনের সুযোগ ছিল না।

আবার বলীখেলার ভেন্যু লালদিঘীর মাঠটির অবস্থান বর্তমান কোর্ট বিল্ডিং অর্থাৎ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান দপ্তরের সামনে। কাজেই এই মাঠে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী এমন কোন কর্মকাণ্ড আয়োজন করা ছিল অসম্ভব।

আরও জানা যায়, কুস্তি বা বলীখেলা চট্টগ্রাম অঞ্চলের অত্যন্ত প্রাচীন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উপকরণ। মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতো তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। আবদুল জব্বার সওদাগরের মতো তখনকার দিনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, জমিদার, প্রতাপশালী ব্যক্তিরা এসব আয়োজন করতেন। সবার লক্ষ ছিল বলীখেলাকে সামনে রেখে শক্তি সমর্থ একটি তরুণ প্রজন্ম তৈরি করা।

আবদুল জব্বারের নাতির স্মৃতিচারণ

আব্দুল জব্বার সওদাগরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, তখন আমার দাদা আবদুল জব্বারের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গণের নামকরা লোকজনের সাথে সখ্যতা ছিল। দাদা সবার সাথে পানসল্লা করে (আলাপ-আলোচনা) করে বলী খেলাটি প্রবর্তন করেন। তখন বর্তমানের মত যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল ছিল না। বলীরা দূরদূরান্ত থেকে বলতে গেলে পায়ে হেঁটেই আসতেন। ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে বলীদেরকে মাঠে আনা হতো। খেলার প্রায় মাস দেড়মাস আগে থেকেই বলীরা চলে আসতেন। নামিদামি বলী, সুঠাম শরীর একেকজনের। আমাদের ডেইরি ঘরে (বৈঠকখানা) তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। দিনভর তারা মুগুর খেলতেন। নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।

এ ব্যাপারে বলী খেলার পরিচালনা কমিটির সদস্য সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল বালি চাটগাঁ নিউজকে বলেন, আবদুল জব্বার সওদাগর একজন বিখ্যাত মানুষ। সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। তার স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের কমিটির পক্ষ থেকে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তার কবরটির যথাযথ মর্যাদা রক্ষা, নামফলক স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমি শওকত আনোয়ার বাদল ভাইকে অনুরোধ করব। আশা করি এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসর ২৫ এপ্রিল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে। বলীখেলা উপলক্ষে ২৪ এপ্রিল থেকে তিন দিনের বৈশাখী মেলা বসবে লালদীঘি মাঠ ও আশপাশের চার বর্গকিলোমিটার এলাকায়।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top