নিজস্ব প্রতিবেদক: একজন আসামি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বা জঙ্গি মতাদর্শের হোক না কেন- তার বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আবার পেশাজীবী হিসেবে সেই জঙ্গি সদস্য বা মতাদর্শীয় আসামির মামলা পরিচালনারও অধিকার আছে একজন আইনজীবীর। তবে এ গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যত্যয় ঘটেছিল বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে।
বিএনপি মতাদর্শী হওয়ায়, আওয়ামী বিরোধী সংগঠনের আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদেরকেই ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিল জঙ্গি মামলায়।
২০১৫ সালে জঙ্গিবাদে নাশকতা ও অর্থায়নের অভিযোগ এনে দুটি মামলায় ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ও জজকোর্টের আইনজীবী মাহফুজ চৌধুরী বাপনকে গ্রেফতার ও রিমান্ডের মাধ্যমে চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন। সেই নির্মম দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে এক প্রকার কেঁদেই ফেললেন গত সোমবার (১০ মার্চ) এসব মামলা থেকে খালাস পাওয়া ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা।
ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার পরিচয়
ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা সুপ্রিম কোর্টের একজন পেশাদার আইনজীবী। তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের হাটহাজারীর লালিয়ারহাটে। তার বাবা মরহুম ওয়াহিদুল আলম ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সাবেক হুইপ ও হাটহাজারী আসনের চারবারের নির্বাচিত এমপি। বিএনপি জোট সরকারের আমলে ওয়াহিদুল আলম সংসদের হুইপ ছিলেন। ওয়াহিদুল আলমের দুই মেয়ের মধ্যে শাকিলা ছিলেন বড়। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি শাকিলা ফারজানা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট শাখার কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য।
দীর্ঘ ১০ বছর আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে দুটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন আইনজীবী শাকিলা ফারজানাসহ অভিযুক্তরা। চলতি বছর ২১ জানুয়ারি হাটহাজারীর ঘটনায় করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আরেকটি মামলায় শাকিলাসহ ৩১ আসামিকে খালাস দেন আদালত।
যেভাবে মামলায় ফাঁসানো হলো
২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, হাটহাজারীর মাদ্রাসাতুল আবু বকর (র.) মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের ১২ জনকে আটক করেছিল র্যাব। এর পরদিন হাটহাজারী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমণি পাহাড়ে ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ থেকে বিপুল অস্ত্রসহ একই সংগঠনের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দুটি মামলায় তদন্ত শেষে হামজা ব্রিগেডকে অর্থায়নের অভিযোগে দুটি মামলায় আইনজীবী শাকিলা ফারজানা ও তিন আইনজীবীসহ ৬১ জনকে আসামি করে র্যাব।
পরে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শাকিলা ফারজানাসহ তিন আইনজীবীকে।
মামলা দুটির চার্জশিট
তদন্ত শেষে ২০১৬ সালে মার্চ মাসে র্যাব মামলা দুটির চার্জশিট দাখিল করে।চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়— বাহরাইনের নাগরিক আল্লামা লিবদির নির্দেশে দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে আসামিরা ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’ নামে জঙ্গি সংগঠনকে অর্থায়ন করছে। বাংলাদেশে বড় ভাই ওরফে জুনাইয়েদ নামের একজন তাদের পরিচালনা করতেন। কিন্তু গ্রেপ্তার আসামিরা বড় ভাই সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি। হামজা ব্রিগেডকে সামরিক, দাওয়াহ ও মিডিয়া নামের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আবার সামরিক বিভাগ হোয়াইট, ব্লু ও গ্রিন নামে বিভক্ত। সামরিক বিভাগের প্রধান হলেন মনিরুজ্জামান ওরফে ডন, দাওয়াহ বিভাগের প্রধান নাছির হোসেন, মিডিয়া বিভাগের প্রধান মো. আবদুল্লাহ। জঙ্গিদের কাছে অস্ত্রগুলো বিক্রি করেন অস্ত্র ব্যবসায়ী মোজাহের মিয়া। জঙ্গি অর্থায়নের জন্য মনিরুজ্জামান ওরফে ডনের তিনটি হিসাব নম্বরে আইনজীবী শাকিলা ফারজানা দুই দফায় ২৫ লাখ ও ২৭ লাখ টাকা, হাছানুজ্জামান দুই দফায় ১৫ লাখ ও ১৬ লাখ টাকা, মাহফুজ চৌধুরী ২৫ লাখ জমা করেন। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করে দুই মামলার বিচার শুরু করেন আদালত।
সাজানো মামলা
২০১৫ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা ও বাঁশখালী লটমনি পাহাড়ে অভিযানের মামলায় অভিযুক্ত আজিজুল হক ও পারভেজকে ‘পলাতক জঙ্গি’ হিসেবে দেখায় র্যাব। সেই সময় র্যাব দাবি করেছিল, আজিজুলের খোঁজে ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমনি পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছে। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে ‘পলাতক’ দেখানো আজিজুল ওই বছরের ৭ জানুয়ারি গ্রেফতার হয়েছেন।
মামলার আসামিদের খালাস
হাটহাজারীর মাদ্রাসাতুল আবু বকর (র.) মাদ্রাসার ঘটনায় করা মামলায় শাকিলাসহ ৩১ আসামি খালাস পান। চলতি বছর ২১ জানুয়ারি তাদের খালাস দেন আদালত। বাঁশখালীর লটমনি পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের মামলায় গত ১০ মার্চ শাকিলা ফারজানাসহ ২৫ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
এ ব্যাপারে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বলেন, আসামিরা আমরা কেউ জঙ্গি ছিলাম না। তৎকালীন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের মতাদর্শী হওয়ায় ষড়যন্ত্র করে এসব মামলায় জড়ানো হয়েছিল আমাদের। এটি ছিল মিথ্যা সাজানো মামলা। এ মামলায় আমি ১০ মাস জেল খেটেছি। ৬ বছর দেশের বাইরে থেকেছি। ১০টা বছর জঙ্গি অপবাদ মাথায় নিয়ে ঘুরেছি। আল্লাহর রহমতে এ বদনাম থেকে পুরোপুরি খালাস পেয়েছি।
চাটগাঁ নিউজ/ইউডি/জেএইচ