নিজস্ব প্রতিবেদক : এস আলম সুগার মিলের ভেতরে এখনও আগুন জ্বলছে। সুগার মিলের অপরিশোধিত চিনির গলিত পানি সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে পোড়া তেল ও ফেনার মতো ভাসছে চিনির বর্জ্য। এতে নদীর পানিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশে মরে ভেসে উঠছে মাছ।
বুধবার (৬ মার্চ) বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৪৭ ঘণ্টাতেও এস আলম সুগার মিলের ভেতরে আগুনের দাপট কমেনি। এতে আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
এর আগে সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে এস আলম সুগার রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিশোধনাগারের ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। গভীর রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে যোগ দেয় নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর দল। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিভানোর কাজ করে।
আগুনে গুদামে থাকা অপরিশোধিত চিনি পুড়ছে। গুদামটির ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার টন। গুদামটি পুরোটা অপরিশোধিত চিনিতে ভর্তি ছিল বলে দাবি করেছে এস আলম কর্তৃপক্ষ। এ রকম আরও চারটি গুদাম রয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতার কারণে আগুন সেগুলোতে ছড়াতে পারেনি।
এদিকে সকালে সরেজমিনে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, কেমিক্যাল মিশ্রিত অপরিশোধিত চিনি আগুনে পুড়ে গলে সোজা কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এরপর নদীতে কেমিক্যাল মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে নদীর মাছ মারা যাচ্ছে। নদী থেকে স্থানীয়রা হাত দিয়েই চিংড়ি কাঁকড়াসহ আরও অন্য মাছগুলো ধরছেন। এ ছাড়া স্থানীয় আরও কয়েকজন হাত জাল ফেলেও মাছ ধরছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, চিনির দাহ্য পদার্থ যখন ৩৮০ ডিগ্রিতে সেলসিয়াসে থাকে তখন বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নেয়। আর সেখানে পানি ছাড়া হলে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন কার্বন তৈরি হয়। যার কারণে কারখানায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেই আগুনে অপরিশধিত চিনি গলে লাভা নদীতে এসে পড়ে। এতেই পানি দূষিত হয়ে মাছ মরছে। চিনির কেমিক্যালে নদী দূষণতো হয়েছেই; এ ছাড়া নদী দূষণের অন্যতম কারণ হলো ১৭টি খালের বর্জ্য ওই নদীতে এসে পড়ছে।
চট্টগ্রামের নেভি অ্যাংকরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাবে। সমুদ্রের পানিতে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এসব কারণে নদীর পানিতে ইকোসিস্টেমে এর প্রভাব পড়বে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়তে পারে।
স্থানীয়রা জানান, সুগার মিলের চিনির কালো পানি নদীতে পড়ছে। এ থেকে মঙ্গলবার থেকেই মাছ মরে ভেসে উঠছে নদীতে। এতে হাত দিয়েই নদীতে মাছ ধরা যাচ্ছে। নদী দূষণের কারণে নদীর মাছ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩৩ প্রজাতির মাছ প্রায় হারিয়ে গেছে।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত জানান, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের আগুন নির্বাপণকাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্য, নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের দুটি টিম, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সহযোগিতা করছেন।
এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেস এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল প্ল্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের এইচ আর ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘর্ষণজনিত তাপ কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রাথমিকভাবে গুদামটিতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এলেও ওপর থেকে পানি ছিটানোর সুযোগ পায়নি। চারদিক থেকে বদ্ধ থাকা গুদামে উত্তপ্ত টিনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢোকারও সুযোগ ছিল না। অল্প কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি।
তিনি বলেন, কারখানার আশপাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট দরকার। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো থাকলে এতো বেগ পেতে হতো না। আগুন নেভানো আরও সহজ হতো। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড। কেননা, গোডাউনের ভেতরে ১২০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। কারণ আগুনের তাপমাত্রা বেশি।
দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ব্যবহার হচ্ছে অগ্নিনির্বাপক রোবট ‘লুফ-৬০’। এ রোবট দিয়ে মিনিটে এক হাজার লিটার স্পিডে পানি ছিটানো হচ্ছে। চিনির কাঁচামালে দাহ্য পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যেতে পারে আরও ৭২ ঘণ্টা।
উল্লেখ্য, এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর পাড়ের ইছানগর এলাকায়। প্রায় দশ হাজার বর্গফুটের এই গুদামটি পাঁচ তলা ভবনের সমান উঁচু। সোমবার বিকেল ৪টার দিকে কারখানার ওই গুদামের ছাদের দিকেই প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা পুরো গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার সময় কারখানাটি চালু ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ