চাল নিয়ে ফের চালবাজি, নাটাই কার হাতে?

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : ভোজ্য তেলের সংকট পুরোপুরি না কাটতেই বাজারে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে চালের দাম। বলা যায়, প্রায় দেড় বছর ধরে দেশে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চিকন ও মোটা চালের দাম এখন সর্বকালের সবচেয়ে বেশি। কয়েক দফা বৃদ্ধি পেয়ে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকায়, নাজিরশাইল ও কেজি প্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

নগরীর সদরঘাটের আল্লাহর দানের মালিক শাহ আজিজের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মধ্যবিত্তদের চাহিদা বেশি এমন চালের মধ্যে রজনী আতপ পাইজাম চালের দাম ছয় মাস আগে ছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা সেই চালের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকায়।

শাহ আজিজ বলেন, ‘ছয় মাস ধরে প্রতি ১৫ দিন পর পর রজনী চালের দাম ৪০-৫০ টাকা করে বেড়েছে। ছয় মাস পর এখন ৫০ কেজি চালের বস্তায় ৫০০-৬০০ টাকা বেড়ে গেছে। এটা কি সাপ্লাই কম হওয়ার কারণে বাড়ছে, না কি মজুত করে রাখার কারণে বাড়ছে, আমরা জানি না। অবশ্য এটা দেশি চাল না, বিদেশ থেকে আমদানি করা চাল।’

জানা গেছে, গত আগস্টে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ফসলহানির প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির অনুমতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু অনুমোদন ও বেশ কয়েকবার সময় বাড়ানোর পাঁচ মাস পরও দেখা যাচ্ছে—ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছিলেন তার চেয়েও অনেক কম পরিমাণ চাল আমদানি করেছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে—গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা অনুমোদিত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চালের বিপরীতে আমদানি করেছে দুই লাখ ৬৩ হাজার টন। যা অনুমোদিত পরিমাণের মাত্র ১৭ শতাংশ।

আমদানিকারকদের ভাষ্য—ডলারের বাড়তি দাম, আমনের ভালো ফলন ও বাজারে আমদানি করা চালের চাহিদা কম থাকায় বর্তমানে চাল আমদানি তাদের জন্য খুব একটা লাভজনক নয়।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, গত আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে এক ধরনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন না, তারা আমদানি করে কতটা লাভ করতে পারবেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি—আমনের ভালো ফলন, সরকারি ক্রয় ও আমদানি দেশে খাদ্য মজুদকে জোরদার করেছে। এটি বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি কম আয়ের মানুষদের জন্য খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি চালাতে সহায়তা করছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নথি অনুসারে—আমদানির জন্য অনুমোদিত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টনের মধ্যে ১২ লাখ ১৯ হাজার টন সেদ্ধ চাল; বাকিটা আতপ। চলতি অর্থবছরে চালের খুচরা দাম গত বছরের আগস্ট থেকে ঊর্ধ্বমুখী। তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় আমন চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ফলন কমে যাওয়ায় চালের দাম যেন আরও না বেড়ে যায় তা রোধ করতে, সরকার মজুদ বাড়াতে ও দাম কমাতে আমদানিকে উত্সাহিত করে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে চালের দামের ওপর মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। ফলে কম-মধ্যম আয়ের মানুষ চাপে পড়েছে।

বাজার অর্থনীতির নীতিসূত্র বলে, চাহিদার নিরিখে সরবরাহ ব্যবস্থায় যদি ঘাটতি থাকে তাহলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যে যতবার বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অদৃশ্য শক্তির বাজারে নাটাই ঘোরানোর প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য চালও এর বাইরে থাকতে পারেনি। আমরা দেখেছি, কারসাজি করে ইতোমধ্যে কয়েক দফা চালের দাম বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। চালের দাম বাড়ার পেছনে মিলারদের চালবাজির বিষয়টিও নতুন কিছু নয়।

এদিকে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান মনে করেন, ‘পরিমিত’ পরিমাণে আমন সংগ্রহ, সরকারিভাবে চাল আমদানি ও জিটুজি আমদানি চুক্তি খাদ্য মজুদকে শক্তিশালী করেছে।

তার মতে, ‘এর ফলে ওএমএস ও টিসিবির কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগের মাধ্যমে বাজারে চাল সরবরাহ স্থিতিশীল করা হয়েছে। ফলে লাখো দরিদ্র পরিবার উপকৃত হয়েছে ও চালের দাম স্থিতিশীল আছে।’

যা বলছেন আমদানিকারকরা

চাল আমদানিকারক আলমগীর হোসেন জানান, ৩৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি থাকলেও তিনি করেছেন মাত্র নয় হাজার টন। ডলারের বাড়তি দাম ও এলসি খোলায় ডলার সংকট বড় বাধা। আমদানি করা চাল স্থানীয় বাজারে লাভজনক নয়। এ কারণে পুরো পরিমাণ চাল আমদানি করিনি।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এলসি খোলার সময় ডলারের দাম হয় ১২২ টাকা। সব ঠিক হওয়ার পর তা বেড়ে হয় ১২২ টাকা ৫০ পয়সা। কেজিতে মাত্র ২৫ থেকে ৫০ পয়সা মুনাফা নিয়ে ব্যবসা করা খুবই কঠিন।’

এসিআই ফুডস লিমিটেডের প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজার মো. জিয়াউর রহমান বলে, আমাদের প্রতিষ্ঠান ছয় হাজার টন আমদানির অনুমোদন পেলেও আমদানি করা হয়েছে এক হাজার ৮০০ টন। আমরা ৭০ টাকা কেজি দরে চাল আমদানি করি। কিন্তু ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি না করলে মুনাফা হবে না। বাজারে চালের দাম বা গুণগত মান কোনোটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

অপর এক আমদানিকারক চিত্ত মজুমদার বলেন, এক লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি পেলেও এখন পর্যন্ত আমদানি করেছি ২২ হাজার টন। চাহিদা কম থাকায় ২২ হাজার টনের মধ্যে ১৫ হাজার টন চাল বিক্রি হয়নি। এখন বিক্রি করলে লোকসান হবে।

প্রতিষ্ঠানটি মাঝারি মানের চাল ৫২ টাকা কেজিতে আমদানি করে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেছে। তিনি আরও বলেন, চাহিদা কম থাকলে আমদানি করে লাভ নেই।

৫০ টাকার নিচে চাল নেই

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে—গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় চালের দাম অপরিবর্তিত আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চিকন চাল ৮০ থেকে ৮৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬৫ থেকে ৬৭ টাকা ও মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।

গত এক মাসের ব্যবধানে চিকন চালের দাম এক দশমিক ২৯ শতাংশ, মাঝারি মানের চালের দাম শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ ও মোটা চালের দাম এক দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে।

গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও মোটা চালের দাম বেড়েছে পাঁচ শতাংশ।

দেশে বছরে তিন কোটি ৭০ লাখ টন থেকে তিন কোটি ৯০ লাখ টন চালের প্রয়োজন। এর বেশিরভাগ দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে চাল আমদানি হয়নি।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top