চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক ছিলেন মো. শরীফ উদ্দিন। দায়িত্ব পালনকালে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দায় করে প্রতিবেদন দেওয়ায় তাদের রোষানলে পড়েন। ২০২২ সালে চাকরি হারান দুদকের আলোচিত এই কর্মকর্তা।
সম্প্রতি দেশের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন হওয়ায় চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে বুধবার (৭ আগস্ট) বেলা ১টার দিকে দুদক কার্যালয়ে সচিব বরাবর আবেদন করেছেন শরীফ উদ্দিন। এতে অপসারণের আদেশ প্রত্যাহারের পাশাপাশি চাকরিতে পুনর্বহালের আবেদনও করেন তিনি।
আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে শরীফ উদ্দিন বলনে, দুর্নীতিবাজদের রোষানলে পরে আমি চাকরি হারিয়েছি, আমি এখন বিচার চাই। আমাকে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কোন প্রকার আত্মপক্ষ সমর্পণের সুযোগ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়। এর মধ্যদিয়ে আমি যে বৈষম্য এবং অন্যায়ের শিকার হয়েছি। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর আমার চাকরি পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করেছি। আমি কমিশনার ও পরিচালক স্যারের সাথে দেখা করেছি। উনারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আমার বিষয়টি তারা বিবেচনা করে দেখবেন।
২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেয় দুদক। আদেশের দিন থেকেই তার চাকরিচ্যুতি কার্যকর বলে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়।
সেই আদেশে উল্লেখ ছিল, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দিন (উপসহকারী পরিচালক) দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির ঘটনায় দুদকের কর্মকর্তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানান কর্মকর্তারা। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
শরীফের আবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমিশনে সততা, বিশ্বস্ততা, অধ্যবসায় ও সর্বোচ্চ ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। এই সময়ে আমি আমার সর্বোচ্চ দক্ষতার সহিত সত্তরেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মামলা সুপারিশ, রুজু ও চার্জশিট দাখিল করে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মামলাগুলো হলো, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অবৈধভাবে পাসপোর্ট ও এনআইডি অনিয়ম সংক্রান্ত ২০ মামলা, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৮৬৩ জন খালাসী নিয়োগের দুর্নীতির মামলা ও সম্পদের অনুসন্ধান, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল করিম ও মো. আমিনের বিরুদ্ধে মামলা, স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে মামলা, কেজিডিসিএল’র শিল্প গ্রাহক আবুল খায়ের গ্রুপ, ক্রাউন স্টিল, বায়েজিদ স্টিলস লিমিটেড, ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড, আরএফ বিল্ডার্সসহ বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু ও সুপারিশ করেছি।
আবেদনে তিনি আরও বলেন, ময়মনসিংহ সজেকায় কর্মকালীন ভালুকা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক সরকারি সম্পদ জাল- জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের দায়ে মামলা রুজু করে ২ জনকে গ্রেফতার, ভূমি অফিসের নাজিরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গ্রেফতারসহ আরও অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছি। এছাড়াও চট্টগ্রাম কর্মরত থাকাকালীন আমার কাছে প্রায় ৭০টি অভিযোগের অনুসন্ধান ও ৪২টি মামলার তদন্তভার ছিল।
এর বাইরেও প্রধান কার্যালয়ের রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট দেওয়া বিষয়ক ৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান টিমের সদস্য, মাহিনী ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড অভিযোগের অনুসন্ধানকারী টিমের সদস্য, ১৫৭ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাঁকখালী নদী দখল, চট্টগ্রাম এল এ শাখার দুর্নীতির বিপরীতে মামলা করার সুপারিশ, মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান, মহেশখালীর ২৭ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান টিমের সদস্য হিসেবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি।
ওইসব অনুসন্ধান ও মামলা অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এবং কতিপয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ পাওয়া যায় বলে তিনি আবেদনে লিখেছেন।
আবেদনে শরীফ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্নীতি ও তদসংশ্লিষ্ট অনিয়মকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে সপরিবারে বিভিন্ন সময়ে প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। তথাপি আমি ও আমার পরিবারের আর্থিক, সামাজিক ও জানমালের নিরাপত্তার দিকগুলো ন্যূনতম বিবেচনায় না নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (চাকরি) বিধিমালা-২০০৮ এর ৫৪ (২) বিধিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কোনোরূপ কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে আচমকাই আমাকে অপসারণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অমানবিকভাবে করা হয়েছে। এ আদেশটি দেওয়ার আগে আমাকে কোনরূপ কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়নি, যা কিনা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫ ( ২ ) অনুচ্ছেদ এবং মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন। এমতাবস্থায় যৌক্তিক, আইনানুগ ও মানবিক কারণসমূহ বিবেচনায় নিয়ে চাকরি হতে অপসারণের আদেশ পুনরীক্ষণের মাধ্যমে প্রত্যাহার পূর্বক চাকরিতে ধারাবাহিকতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ পুনর্বহালের জন্য হুজুরের অনুকম্পা প্রার্থনা করছি।
এর আগে, ২০ ফেব্রুয়ারি দুদকের কনফারেন্স রুমে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ১৩টি কারণের কথা জানান। পরের দিন এক ভিডিও বার্তায় কারণগুলোর জবাব ও ব্যাখ্যা দেন শরীফ।
চাটগাঁ নিউজ/এআইকে