হাসান সৈকত : চট্টগ্রামের জেলা ও উপজেলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। কিন্তু এখানে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের। বকশিশ (টাকা) দিতে হচ্ছে বিনামূূল্যের চিকিৎসাসেবা পেতে। হাসপাতালের বেড থেকে শুরু করে বিনামূল্যের ওষুধসহ কোনোকিছুই মিলছে না টাকা ছাড়া। শুধু তাই নয়, টাকার জন্য রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কর্তব্যরত আয়া-সেবিকারা।
বুধবার (১২ মার্চ) হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীদের প্রয়োজনীয় ফরমালিটি সম্পন্ন করতেই লেগে যায় ১ ঘণ্টারও বেশি সময়। এছাড়া ওয়ার্ড বয়, নার্স, আয়া-বুয়াদের বকশিশের উৎপাত তো আছেই। বকশিশ না দিলেই বন্ধ হয়ে যায় সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা।
জানা যায়, প্রয়োজনীয় ফরমালিটি শেষ করে ওয়ার্ডে ভর্তি হলেও টাকা না দিলে পাওয়া যায় না সিট। জায়গা হয় হাসপাতালের মেঝেতে।
এ নিয়ে মো. রিয়াদ হাসান নামের রোগীর স্বজন এক জানান, রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করালেও আমরা কোন সিট পাইনি। রোগীকে ফেলে রাখা হয় মেঝেতে। পরে একজন বললো ওয়ার্ড বয়কে টাকা দিলেই মিলবে সিট। তা না হলে মেঝেতেই রাখা হবে রোগীকে। কোনো উপায় না পেয়ে ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে একটি সিট ম্যানেজ করতে হয়েছে।
অনেকেই আবার এই ঘুষের টাকাকে নাম দিয়েছেন স্পিড-মানি হিসেবে। ঘুষ বললেই রেগে যান ওয়ার্ড বয়, নার্স, আয়া-বুয়ারা। তাদেরকে খুশির তুলনায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই দিতে হয় বখশিশের টাকা।
রুহুল আমিন নামে এক রোগীর নাতী জাহেদুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে আসার পর থেকেই কাউকে না কাউকে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। ওয়ার্ড বয়কে ৪০০ টাকা দিয়ে সিট ম্যানেজ করেছি। এর আগে নিচ তলা থেকে তিন তলায় আনতে ট্রলি ব্যবহারের জন্য দিতে হয়েছে ৩৫০ টাকা। লিফ্ট ব্যবহারে দিতে হয় প্রতি বার ২০ টাকা করে। আবার হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হলে দিতে হয় ১০০-২০০ টাকা।
মামুন নামের অন্য একজন বলেন, অপারেশন হলে রোগীকে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকার ওষুধ কিনে ডাক্তারকে দিতে হয়, যা অফেরতযোগ্য। পরে নার্সরা ওই ওষুধ দোকানে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে দেন। যদি কোন কারণে রোগী মারা যায়, তাহলে চিকিৎসা খরচ ও মানুষ উভয়ই শেষ! আর যদি অপারেশন সফল হয়, তবে প্রতিদিন ড্রেসিং ও ওষুধের জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা।
এছাড়াও ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পর রোগীর সাথে একজনের বেশি প্রবেশ করলে দিতে হয় জন প্রতি ২০ টাকা। আবার কয়েক ঘন্টা পর পর স্যালাইন পরিবর্তন ও নতুন স্যালাইন লাগিয়ে দিতেও নার্স-ওয়ার্ড বয়রা নেন ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এরপর রোগীকে রিলিস দেওয়ার সময় আবারো খুশি করতে হয় নার্স-ওয়ার্ড বয় ও দারোয়ানকে।
এভাবে খুশি করতে করতে এক প্রকার হাঁপিয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। যেন এই জাল থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে বকশিশ নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে রুবেল নামের একজন ওয়ার্ড বয় বলেন, আমরা বিনা বেতনের কর্মচারী, আমার মতো আরো ৫০ জন এই হাসপাতালে কাজ করে। আমরা সম্পূর্ণ বকশিশের উপর নির্ভরশীল। তবে আমরা কাউকে জুলুম করি না, যে যা দেয় তাতেই খুশি।
তবে রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা মিলছে না। তারা আশা করছেন, সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সবগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কারণ সরকারি এসব হাসপাতালে আমরা রোগীদের মাটিতে শুইয়ে রেখে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাদের জন্য একটা বেডেরও আমরা ব্যবস্থা করতে পারি না।
তিনি বলেন, চমেক হাসপাতালে দুই হাজার রোগীর ক্যাপাবল থাকলেও প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে সাড়ে ৩ হাজারও বেশি। ফলে রোগীরা অবহেলার শিকার হয়। সুতরাং চট্টগ্রামে অন্তত ৫০০ বেডের আর দুটি হাসপাতাল গড়ে তোলা অতীব জরুরি।
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীনের সাথে। তিনি চাটগাঁ নিউজকে বলেন, রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা আমাদের জন্য সবার উপরে। চিকিৎসা নিতে আশা কোনো রোগী দুর্ভোগে পড়ুক-তা আমরা চাই না। এই ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছি।
বকশিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ যদি অনৈতিকভাবে কোন রোগী বা তার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা দাবি করে তবে প্রমাণ সাপেক্ষে ওই কর্মচরীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ