নিজস্ব প্রতিবেদক: সংঘর্ষবিহীন দিন পার করলেও এখনো গুমোট ভাব কাটেনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৪৪ ধারা জারি হওয়ার পর থেকে চবি ক্যাম্পাস ও জোবরা গ্রামে রণসাজে সজ্জিত সেনাবাহিনীর টহল দেখা গেছে। এরই মাঝে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করেছে চবির নারী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকল পরীক্ষা স্থগিত করলেও ক্লাস চলবে কি না সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি চবি প্রশাসন।
আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে ক্যাম্পাস ছিল একদম চুপচাপ। শিক্ষার্থীদের কোলাহলপূর্ণ এলাকাগুলো ছিল ফাঁকা, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকা বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগে নেমে এসেছে পিনপতন নীরবতা। যেন চতুর্দিকে বিরাজ করছে শংকা, ভয় আর আতংক!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে— বিশ্ববিদ্যালয়ের কলার ঝুপড়ি, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, শহীদ মিনার, সেন্ট্রাল ফিল্ড, গোল চত্বর, রেল স্টেশন ও দুই নম্বর গেট এলাকা অনেকটাই ছিল ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন শিক্ষার্থী দেখা গেলেও তা ২৩’শ একরের ক্যাম্পাসের তুলনায় নগণ্য । যদিও স্বাভাবিক সময়ে এসব এলাকা দিনভর শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখর থাকে।
তবে এরই মধ্যে প্রশাসনিক ভবনে চলেছে নিয়োগ পরীক্ষা ও অন্যান্য অফিস কার্যক্রম। স্বাভাবিক নিয়মেই চলাচল করছে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাস ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের বাহন শাটল ট্রেন।
১০ সিদ্ধান্ত চবি প্রশাসনের
এদিকে আজকের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতসহ ১০টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র প্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জরুরি সভা শেষে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন জানান, দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ বৈঠকে মোট ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আজকের মধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করবে। এজন্য পাঁচ শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি চিকিৎসা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় একটি মডেল থানা স্থাপনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বৈঠকে। একইসঙ্গে রেলক্রসিং এলাকায় একটি পুলিশ বক্স স্থাপন করা হবে।
এই সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। পাশাপাশি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রত্যাহার না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি হটলাইন সার্ভিস চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২ নম্বর গেট সংলগ্ন জোবরা এলাকার বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্যও একটি বিশেষ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চবি ছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল
চবির উপাচার্য কার্যালয়ে যখন গ্রামবাসী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করছিলেন চবি ভিসি-প্রোভিসিগণ, তখন চবির বিভিন্ন ছাত্রী হল থেকে ছাত্রীরা জুলাই উদ্যানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করেন। এসময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতেও শোনা গেছে।
আজ সোমবার বিকেল ৩টায় এই বিক্ষোভ মিছিল অনুুষ্ঠিত হয়। পরে মিছিল সহকারে ছাত্রীরা শহীদ মিনার হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। সেখানেও উপাচার্যকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। পরে বিকেল সাড়ে ৪টায় বুদ্ধিজীবী চত্বরে গিয়ে এই বিক্ষোভ মিছিলটি শেষ হয়।
জোবরাবাসীদের সাত দফা দাবি
চবি শিক্ষার্থী ও জোরাবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর জোরাবাসী প্রশাসনের কাছে সাত দফা দাবি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, বারবার অশান্তি ও সহিংসতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি।
সোমবার (০১ সেপ্টেম্বর) জোবরা সমাজ সংস্কার ও উন্নয়ন পরিষদ (জোসউপ) নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এ দাবি জানানো হয়।
স্থানীয়দের দাবিগুলো হলো— এলাকায় মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সংঘর্ষে যারা উসকানি দিয়েছে তাদের আজীবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা, সংঘর্ষে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর মধ্যে সমস্যা হলে প্রশাসন ও এলাকার জনপ্রতিনিধিদের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা, ভাড়া বাসায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের শালীন আচরণ বজায় রাখা, ভাড়া বাসায় মাদকসেবন ও নারী-পুরুষের অনৈতিক অবস্থান এবং গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চস্বরে চিৎকার বা গানবাজনা বন্ধে কঠোর নজরদারি, ভবিষ্যতে এ ধরনের সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত তদারকি জোরদার করা।
১৪৪ ধারা বহাল রাখার দাবি শিবিরের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির।
সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান চবি শাখা ছাত্রশিবিরের নেতারা।
শিক্ষার্থীদের ওপর ‘স্থানীয়দের হামলা’ এবং ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ডাকা এ সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, সব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা ও পুরো এলাকা অস্ত্রমুক্ত করা, ক্যাম্পাসের স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি রাখা।
প্রশাসনের বক্তব্য
চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় রোববার থেকে সব ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে চলতি সপ্তাহের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। তবে ক্লাস হবে কি না, সে বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার খরচ চবি কর্তৃপক্ষ বহন করবে বলেও তিনি জানান।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কাওছার মোহাম্মদ হোসেন জানান, সোমবার সকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে আটক করা হয়নি। তবে মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা সংকটের কারণে উদ্বিগ্ন। প্রশাসন থেকে দ্রুত পদক্ষেপ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াও চলমান। সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত দুই শিক্ষার্থীকে নগরের বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরেকজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত শনিবার রাত সোয়া ১২টার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক ছাত্রী ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটের কাছে তার ভাড়া বাসায় ফেরার সময় ভবনের দারোয়ান তার সঙ্গে অসভ্য আচরণ করে মারধর করেন। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে আটকানোর চেষ্টা করলে তিনি পালিয়ে যান।
এ ঘটনায় স্থানীয় জোবরা গ্রামের লোকজন শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল রড, পাইপ, কাঠের লাঠি; স্থানীয়দের হাতে ছিল রামদা, রড ও লোহার পাইপ। সংঘর্ষ দ্রুত গ্রামের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক শিক্ষার্থী আটকা পড়ে মারধর হন। ধারালো অস্ত্র ব্যবহারে বেশ কয়েকজন রক্তাক্ত হন। আহতদের মধ্যে তিনজনকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানানো হয়।
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ