চট্টগ্রাম আদালতে বন্দি স্বজনদের দেখতে ভিড়-কান্নাকাটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনকেও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ ওঠেছে। এসব বন্দিদের এক নজর দেখতে কিংবা জামিনের জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আদালতে ভিড় করছেন তাদের স্বজনরা।

সোমবার (২৯ জুলাই) সরেজমিন চট্টগ্রাম আদালত ঘুরে দেখা গেছে, আদালতের গারদের সামনে বাবা-মা অপেক্ষা করছেন তার সন্তানের জন্য, স্ত্রী অপেক্ষা করছেন স্বামীর জন্য, ছেলে অপেক্ষা করছেন বাবার জন্য কিংবা ভাই অপেক্ষা করছেন ভাইয়ের জন্য। কারও হাতে খাবার, কারও হাতে  কাপড়- চোপড় নিয়ে। সবার চোখে মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেককে স্বজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেও দেখা গেছে।

দেখা গেছে, আদালত পাড়ায় একেকটি প্রিজন ভ্যান ঢুকতেই আপনজনের খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন উদ্বিগ্ন স্বজনরা। অনেকে ভোরের আলো না ফুটতেই স্বজনের খোঁজে এসেছেন আদালতে। গেল কয়েকদিনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ জড়িত সন্দেহে অনেককে গ্রেফতার করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্বজনরা।

গারদের সামনে মোস্তফা শেখ নামে এক মাঝবয়সি ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি। প্রিজনভ্যানে তোলার সময় জড়িয়ে ধরেছিলেন তার ছেলেকে। নাম রমজান শেখ। রমজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। চট্টগ্রামের মুরাদপুরের ফরেস্ট গেট এলাকায় একটি ভাড়াবাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন রমজান। সেখানে একটি কোচিং সেন্টারে পড়ান তিনি।

মোস্তফা শেখের দাবি, রমজানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর তাকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পাঁচলাইশ থানা-পুলিশ। এক সপ্তাহের মাথায় নাশকতার আরও একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। রমজান ছাড়াও গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীকে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে চবি ও চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর একদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তাদের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।

জানা গেছে, ২০ জুলাই রাতে রমজানকে মুরাদপুর মোড়ে সংঘর্ষ, হত্যা ও নাশকতার অভিযোগে দায়ের হওয়া একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এই ঘটনার সাত দিন পর গতকাল রমজানকে আরও একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন আদালতে পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ড আবেদন করা হয়। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃতরা জামিন আবেদন করেছেন। তবে এদিন কারও জামিন মঞ্জুর হয়নি। এদের মধ্যে রমজানের মতো অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের একজন মোহসেন আলম। তিনি চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। ১৭ জুলাই তাকে জিইসির মোড় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে খুলশী থানায় দায়ের হওয়া নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন কারাগারে পাঠানো হয়। রবিবার রিমান্ড আবেদনসহ মহানগর ষষ্ঠ আদালতে হাজির করা হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মোহসেন বারবার খোঁজ নিচ্ছিলেন তার পরিবারের কেউ এসেছে কি না? তবে শেষ পর্যন্ত কারও দেখা মেলেনি। আসেনি মোহসেনের আইনজীবীও।

শুনানি শেষে অন্য আইনজীবীরা বলেন, ‘আদালত সবার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন।’ এসব মামলায় শ্রমজীবী মানুষকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে দাবি ভুক্তভোগী  স্বজনদের। তেমনই একজন সাকিব। তিনি সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী। পরিবার নিয়ে থাকেন হালিশহরের বড়পোল মোড়ে। ওই রাতে কাজ শেষে ফেরার পথে হালিশহর থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে খুলশী থানায় হস্তান্তর করা হয়। সাকিবের মা বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ধরে নিয়ে গিয়ে আসামি করা হয়েছে।’

একইভাবে মামলার আসামি হয়েছেন জুবলি রোডের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মো. সাজেদ। কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সাথে সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন প্রতিবেশী গৌতম দেব। তবে তার বংশের লোকজন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। তিন জানান, বাড়িতে সাজেদের শয্যাশায়ী মা।  পরিবারে আর কেউ না থাকায় প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিতে আসেন তিনি। সন্তানের কথা শুনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সাজেদের মা। এই মুহূর্তে তাকে দেখার আর কেউ নেই।

পুলিশ জানায়, বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লকরেইড’ দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানায় ২০টি মামলা ও জেলার হাটহাজারী, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি, ভুজপুর, মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানায় ১১টি মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার জনকে।

চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় দায়ের হওয়া ৩১ মামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে জেলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৭ এবং নগরীতে ১৬ জন। এ নিয়ে চট্টগ্রামে গত ১৩ দিনে গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ৯২০ জন। এদের সবাইকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চাটগাঁ নিউজ/এআইকে/এসএ

Scroll to Top