চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: একসময় চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট,পুকুর পাড়, খাল-বিল,নদীর পাড়ে দেখা মিলত সারি সারি তালগাছ। সে তালগাছগুলোতে আশ্চর্য মুন্সিয়ানায় বাসা বুনত বাবুই পাখিরা। কাঁচা তালের খোসা, পাকা তালের রসের পিঠা, তালের তাড়ি,তালের মিছরি এ এলাকার জনমানুষের আদরনীয় বস্তু। তবে কালের বিবর্তনে চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তালগাছ। আর তার সাথে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি।
অথচ এই তালগাছ আর বাবুই পাখি এ অঞ্চলের জীবনচরিত্রে চিরায়ত। এই তালগাছ আর বাবুই পাখিকে নিয়ে কবিরা লিখেছেন কবিতা,গান। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’- এ কথার মধ্য দিয়ে কবি সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে তালগাছের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন।
কিংবা ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।’- এ কথার মধ্য দিয়ে কবি বাবুই পাখির সংগ্রাম মুখর জীবন, শিল্পচিন্তা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাবের জয়গান ব্যক্ত করেছেন।
জানা যায়, সাবেক কালের চট্টগ্রামের আনোয়ারা, চন্দনাইশ, বোয়ালখালী,পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, রাউজান, হাটহাজারী,রাঙ্গুনিয়াসহ প্রায় পুরো অঞ্চলেই প্রচুর তালগাছ দেখা যেত। তৎকালীন চট্টগ্রামের জনজীবনের সাথে তালগাছ জড়িয়ে ছিল ওতপ্রোতভাবে। একটি তালগাছের রয়েছে বহুমুখী উপযোগিতা। তালগাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় হাতপাখা। একসময় গ্রামে গ্রামে তাল পাতার ক্রেতারা হাঁক দিয়ে তালগাছ খুঁজত। কাঁচা তালের খোসা বরাবরেই প্রিয় খাদ্য। পাকা তালের রস দিয়ে বাঙ্গালিরা তৈরি করে পিঠাপুলি,সন্দেশসহ হরেক রকম পদ।
তাছাড়া খেজুর গাছের মত তালগাছ থেকেও বিশেষ পদ্ধতিতে রস বের করত গাছিরা। এ রসকে বলা হয় ‘তাড়ি’। পটিয়ার কেলিশহর, চক্রশালা এলাকার তালের তাড়ি খেতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসত। এ তাড়ি খেলে হালকা মাদকতা আসে শরীরে। তালের রস দিয়ে মূলত বানানো হত তালের মিছরি। এ তালের মিছরি নিয়মিত সেবন করলে সর্দি,কাশি, ব্রঙ্কাইটিস রোগ আরোগ্য হয় বলে চিকিৎসা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।
বর্তমানে চট্টগ্রামে আগের মত আর তালগাছ দেখা যায় না। ইট ভাটায় তালগাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার, তালগাছ রোপন ও পরিচর্যায় অসচেতনতার কারণে দিন দিন তালগাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
চন্দনাইশ কাঞ্চননগর এলাকার বাসিন্দা রতন বিশ্বাস জানান, আমাদের বালক বয়সে দেখতাম জোয়ারা,কাঞ্চননগর, বাদামতল,মোহাম্মদপুর,ফতেনগর, হারলা,বরমা,সুচিয়া,বৈলতলী,দোহাজারীসহ অত্র অঞ্চলে প্রচুর তালগাছ আর খেজুর গাছ ছিল। আমার বাবা গাছ কাটতেন। এই শীতকালে বাবার সাথে আমিও গাছ কাটার কাজে বের হতাম। বাবা গাছে উঠে গাছ চেঁছে হাঁড়ি বসিয়ে বসিয়ে চলে যেতেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে তিনি গাছ কাটতেন। সব গাছ কাটা শেষ করে আবার প্রথম গাছটির কাছে আসতে তার ঘন্টা তিনেক সময় লাগত। দেখা যেত এই সময়ের মধ্যে প্রথম গাছের হাঁড়ি রসে পূর্ণ হয়ে গেছে। তালের তাড়ি খেতে অনেক দূর থেকেও লোকজনকে আসতে দেখেছি।
তিনি আরও বলেন, এখন আর সেই তালগাছ নেই। দু’চার মাইল ঘুরলেও একটা তালগাছ দেখা যাবে না। মানুষ এখন তালগাছ রোপন করে না। আগে কৃষিজীবী মানুষ তালগাছ লাগাত। যত্ন আত্তির করত। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম তালগাছ নাকি বজ্রপাতে মৃত্যু মোকাবেলায়ও উপকারী গাছ। তালগাছ যেখানে নেই, সেখানে বাবুই পাখিরাও হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ এ পাখি বাসা বাঁধে উঁচু একাকী গাছে। যাতে শিকারীরা অন্য গাছ থেকে তার বাসার নাগাল না পায়। তাছাড়া বাবুই পাখি দোল খাওয়া বাসা পছন্দ করে। তাই তালগাছেই তারা দৃষ্টিনন্দন মজবুত বাসা বানায়। বাবুই পাখি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে তালগাছ কমে যাওয়া অন্যতম। তবে বাবুই পাখিরা ক্ষেতের ধান, ডাল, সরষে জাতীয় শস্য খেয়ে জীবন ধারণ করে। বর্তমানে কৃষিকাজে ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে গেছে। পাখিরা কীটনাশক মিশ্রিত শস্য খেয়ে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে, কাক জাতীয় পাখির প্রাদুর্ভাবে প্রকৃতিতে খাদ্যাভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে বাবুই,চড়ুই,বুলবুলি, ফিঙ্গে জাতীয় ছোট পাখিগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
তবে চট্টগ্রামে তালগাছ হারিয়ে যাওয়া বৃক্ষের তালিকাভুক্ত হলেও দেশের দিনাজপুর,পঞ্চগড়, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ কয়েক জেলায় তালগাছ রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ সালে বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে দেশব্যাপী তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত হয়। দেশের বিভিন্ন উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার দুই ধারে তালের আঁটি রোপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৮ সালে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গৃহিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয়। সারাদেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় বলে বলা হলেও প্রকল্পের বাস্তবতা নিয়ে সেসময় নানা প্রশ্ন উঠেছিল। প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়।
চাটগাঁ নিউজ/ইউডি