নিজস্ব প্রতিবেদক : খাল ও নালায় পড়ে ১৫ জনের মৃত্যুতেও যেন টনক নড়ছে না প্রশাসনের। নগরীর বেশির ভাগ খালে এখনো বসানো হয়নি স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যারিয়ার। তবে সম্প্রতি খালে পড়ে শিশু সেহেরিশের মৃত্যুর পর দুর্ঘটনাস্থলে বাঁশের অস্থায়ী ব্যারিয়ার লাগিয়ে যেন দায় সেরেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ!
যদিও স্থানীয়দের দাবি বাঁশের বেড়াগুলোর অধিকাংশ স্থানীয়দের দেওয়া। তাদের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত ব্যারিয়ার বসানোর উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ফলে নগরীর উম্মুক্ত খালের আশেপাশে থাকা বাসিন্দারা ভয়, আতঙ্ক আর শঙ্কা নিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে অরক্ষিত খাল ও নালার পাশে স্থায়ী নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে আলাদা কোনো বরাদ্দও নেই এসব প্রকল্পে। কার্যকর কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় প্রতি বছরই উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে— নগরীর চাক্তাই খালের বেশ কিছু অংশ, কাপাসগোলার হিজড়া খাল, মুরাদপুরের চশমা খাল ও আগ্রাবাদের মহেশ খালের প্রায় অংশ অরক্ষিত। খালগুলোর কিছু অংশে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসানো হলেও এখনো বেশ কিছু অংশ রয়ে গেছে বিপজ্জনক অবস্থায়। বিশেষ করে শিশু সেহেরিশের হিজড়া খালে তলিয়ে যাওয়ার স্থান ও পাঁচ কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালে তার মরদেহ উদ্ধার করার স্থানে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসানো হয়েছে। তাও আবার অস্থায়ীভাবে ঠুনকো কাঠ ও বাঁশ দিয়ে। অন্যান্য স্থানগুলো এখনো আগের মতোই খোলা ও ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।
আগ্রাবাদের মহেশখাল পাড়ের বাসিন্দা করিম মাওলা (৫৮) বলেন, এই খালে একসময় আমরা নৌকা চলতে দেখেছি, তবে তখন এতো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। দিন দিন এই খাল ছোট হয়ে এখন নালায় পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যা বেড়েছে, তবে বাচ্চাদের খেলার জায়গা কমছে। এতো এতো মৃত্যুর খবরে নিজের নাতি-নাতনির জন্য সারাক্ষণ ভয়ে থাকতে হয় খালের কাছে বাড়ি বলে।
চাক্তাইয়ের বাসিন্দা নাইম আজাদ নামের এক আইনজীবী বলেন, গত চার বছরে নিরাপত্তা ব্যারিয়ার ও স্লাববিহীন নালা-খালে পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারো মৃত্যু হলেই শুরু হয় প্রশাসনের তোড়জোর, তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই সব আগের মতো।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে সড়কের পাশে উন্মুক্ত নালা-নর্দমা, ড্রেন ও খালের মোট ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার জায়গায়। এসব জায়গার মোট আয়তন প্রায় ১৯ কিলোমিটার। নগরীর এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা-নর্দমা আর খালের মধ্যে চসিকের নিয়ন্ত্রণে আছে এক হাজার ৩০০ কিলোমিটার এবং বাকি অংশ সিডিএর। চট্টগ্রাম নগরীতে বর্তমানে ৫৭ খাল ও ৯৫০ কিলোমিটার নালা রয়েছে, যার বেশির ভাগেই নেই নিরাপত্তা দেয়াল। মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হলেই খালের আশপাশ এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। তখন খাল আর রাস্তা আলাদা করা যায় না। নিরাপত্তাবেষ্টনীহীন এসব খাল তখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়।
বিষয়টি নিয়ে চুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৫ সালে এসেও প্রকল্পটি এখনো চলমান রয়েছে। এর মূল কারণ জবাবদিহিতার অভাব।
সিডিএ ও চসিকের উচিত এসব কাজে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। জবাবদিহি থাকলেই কাজের অগ্রগতি হবে, তা না হলে বছরের পর বছর ধরে প্রকল্প চলমান থাকবে। কিন্তু কোন অগ্রগতি হবে না। উল্টো মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে নগরবাসীর।
চার প্রকল্পে স্থায়ী বেষ্টনীর বরাদ্দ নেই
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প এবং দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক দুটি প্রকল্পের কাজ চলমান।
এ ছাড়া চসিকের রয়েছে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ‘নগরের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ শীর্ষক প্রকল্প এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে আছে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ। তিন সংস্থার এ চার প্রকল্পের কোনোটিতেই খালের পাড়ে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে স্থায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, খাল খনন ও মাটি সরানোর কাজটি প্রকল্পের আওতাভুক্ত। কিন্তু খালের দুই পারে রেলিং নির্মাণ করা প্রকল্পে নেই। তারপরও উপযাজক হয়ে আমরা এর মধ্যে কয়েকটি স্থানে রেলিং দিয়েছি।
এ ব্যাপারে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসাইন বলেন, খালে পড়ে মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়। ইতোমধ্যে আমরা ৩৬টি খালের বিভিন্ন অংশে সাময়িক নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়েছি । যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনী স্থাপন করা হবে। আমরা এটির চিরস্থায়ী সমাধানে কাজ করে যাচ্ছি।
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, সিডিএর ৩৬টি খাল নিয়ে কাজ চলছে, তা সেনাবাহিনী করছে। যে খালে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে খালটির কাজ আমরা এখনো শুরু করিনি। পর্যায়ক্রমে খালের কাজ শুরু হচ্ছে। যেসব খালের কাজ সম্পন্ন হয়েছে সবগুলো খালেই আমরা প্রটেকশনের ব্যবস্থা নিয়েছি, প্রকল্প অনুযায়ী সবগুলোতে দেড় থেকে দুই ফিট করে রেলিং দেওয়া আছে।
১৫ জনের মৃত্যু
২০১৭ সাল থেকে নগরের এসব খাল ও নালা-নর্দমায় পড়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৫ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে এক, ২০১৮ সালে এক, ২০২১ সালে পাঁচ, ২০২২ সালে এক, ২০২৩ সালে তিন, ২০২৪ সালে তিন ও চলতি বছর এক জন। এতো প্রাণহানির পরও টনক নড়েনি সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। উন্মুক্ত নালাগুলো এখনও অরক্ষিত। কোনও ধরনের স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
কাজ তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিতে দুদকের হানা
উন্মুক্ত নালায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পড়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো গাফেলতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম খাল-নালা পরিদর্শন ও অভিযান পরিচালনা করে।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারি পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লিখিত প্রস্তাবিত রেলিংয়ের দৈর্ঘ্যের সাথে পরিদর্শনকালে প্রাপ্ত দৈর্ঘ্যের মিল পাওয়া যায়নি। তাছাড়াও আরও কিছু অনিয়ম দৃষ্টিগোচর হয়েছে আমাদের। আমরা উভয় সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চাই।
চাটগাঁ নিউজ/এইচএস/জেএইচ/এসএ