উজ্জ্বল দত্ত : নয় মাসে চট্টগ্রামে চারটি কিলিং মিশনে ছয় জন নিহত হয়েছেন। একের পর এক এসব কিলিং মিশনের নেপথ্য নির্দেশদাতা হিসেবে উঠে এসেছে বিদেশে অবস্থানরত চট্টগ্রাম আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ খানের (বড় সাজ্জাদ) নাম। পুলিশের ধারণা, এই সাজ্জাদ খানের নির্দেশে তার সাগরেদ কারাবন্দি ছোট সাজ্জাদ বাহিনীর মাধ্যমে এই সিরিয়াল হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে। কিলিং মিশনের সর্বশেষ শিকার ঢাকাইয়া আকবর (আলী আকবর)। মিশনগুলোতে নিহতরা চট্টগ্রাম আন্ডার ওয়ার্ল্ডের আরেক গ্রুপ সরোয়ার হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
সাজ্জাদ খান আর সরোয়ার হোসেনের দ্বন্দ্বের এই সমীকরণে সাজ্জাদ খান (বড়) বাহিনীর ছোট সাজ্জাদ, সাজিবসহ বেশ কয়েকজন বর্তমানে কারাবন্দি। অপরদিকে সরোয়ার হোসেন বাহিনীর সদস্যরা একে একে মারা যাচ্ছে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আন্ডার ওয়ার্ল্ড দাবার এই খেলায় বর্তমানে সাজ্জাদ খানের (বড় সাজ্জাদ) শক্তিগুলো কারাবন্দি। আর সরোয়ার হোসেনের শক্তিগুলোর অনেকেই নিহত। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘ফিউচার ডন’ কে হতে পারেন, সাজ্জাদ খান (বড়) নাকি সরোয়ার হোসেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে প্রশাসন।
ঘটনা প্রবাহ
(১) গত ২৩ মে সন্ধায় পতেঙ্গা সি বীচে কয়েকজন বন্ধু ও এক নারীসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন সন্ত্রাসী ঢাকাইয়া আকবর। এমন সময় চারটি মোটরসাইকেলে করে দুর্বৃত্তরা এসে ঢাকাইয়া আকবরকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে করে ঢাকাইয়া আকবর গুলিবিদ্ধ হন। তার শরীরে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। ২৫ মে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকাইয়া আকবর মারা যান।
(২) ২০২৪ সালের ২৯ আগষ্ট অনন্যা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে মাসুদ কায়সার (৩২) ও মোহাম্মদ আনিস (৩৮) নামে দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত এই দুইজন ছিলেন সরোয়ার হোসেনের অন্তরঙ্গ সিপাহি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরোয়ার হোসেন এই দুইজনের মাধ্যমে এলাকার গার্মেন্টস জুটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়।
(৩) ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানাধীন শমসের পাড়াস্থ অদুর পাড়া এলাকায় বালু ব্যবসায়ী মো. তাহসিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জানা যায়, বালু ব্যবসায়ী এই তাহসীনের সাথেও সরোয়ার হোসেনের সখ্যতা ছিল। বালুর ব্যবসার আধিপত্য ও বালুর মহাল নিয়ে তাহসিনের সাথে সাজ্জাদ খানের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছোট সাজ্জাদ বাহিনীর দ্বন্দ্ব থেকেই এ কিলিং বলে ধারণা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
(৪) ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ রাতে সরোয়ার হোসেন ও তার চার বন্ধু প্রাইভেট কারে করে শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে নগরে আসার পথে বাকলিয়া এক্সেস রোড চত্বরে হামলার শিকার হন। একদল মোটরসাইকেল আরোহী তাদের প্রাইভেট কার ধাওয়া করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এ কিলিং মিশনে প্রাইভেট কারচালক মোহাম্মদ মানিক (৩০) ও সরোয়ারের বন্ধু আবদুল্লাহ (৩২) নিহত হন। তবে সেদিন সরোয়ার হোসেন ওই গাড়িতে থাকলেও তিনিসহ চারজন বেঁচে গিয়েছিলেন। নতুন ব্রিজ এলাকায় জমি দখল, বালুর ব্যবসা ও সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার আক্রোশ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ড পরবর্তী গ্রেফতার আসামিদের জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, সরোয়ার হোসেনও একসময় সাজ্জাদ খানের (বড় সাজ্জাদ) একনিষ্ঠ সাগরেদ ছিলেন। এই দলে ছিলেন ম্যাক্সন নামের আরেক সদস্য। চট্টগ্রামের এইড মার্ডার মামলায় নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাজ্জাদ খান হাইকোর্টে খালাস পেয়ে বিদেশে চলে যান। বিদেশ থেকে তিনি ম্যাক্সনকে দিয়ে চট্টগ্রামের আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। তখন সরোয়ার হোসেন ও ম্যাক্সন-এই দুইজনই ছিলেন সাজ্জাদ খানের ঘনিষ্ঠ সাগরেদ। কিন্তু কিছুদিন পর ম্যাক্সনকেও ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। আর এ পরিস্থিতিতে সরোয়ার হোসেনের সাথে নানা বিষয়ে গুরু সাজ্জাদ খানের সাথে দর কষাকষি শুরু হয়। একপর্যায়ে সরোয়ার হোসেন নিজেই বাহিনী গড়ে তুলেন। এর মধ্য দিয়ে সাজ্জাদ খানের সাথে সরোয়ারের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। তখন সাজ্জাদ খান তার গ্রুপের নির্ভরযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলেন বর্তমানে কারাবন্দি সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদকে।
এদিকে, ঢাকাইয়া আকবর খুনের ঘটনায় গত ২৬ মে সোমবার তার স্ত্রী রূপালী বেগম বাদি হয়ে পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে ২-৩ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। ওই দিন চান্দগাঁও থানাধীন সিডিএ আবাসিক এলাকাস্থ একটি বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান থেকে সাজ্জাদ খানের বড় ভাই ওসমান আলী ও তার বোনের ছেলে আলভীনকে আটক করেছে র্যাব-৭।
এ বিষয়ে র্যাব-৭ সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার (মিডিয়া) এ আর মোজাম্মেল বলেন, চান্দগাঁও থানার সিডিএ আবাসিক এলাকা থেকে ওসমান আলী ও আলভীনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় মামলা আছে। আটককৃতদেরকে পতেঙ্গা থানার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ