চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাছকাটার সিদ্ধান্তে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা ইতোমধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভে সরব হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পর বিক্ষোভ গড়াচ্ছে মাঠেও। নাগরিকরা বলছেন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে র্যাম্প নির্মাণের প্রয়োজন নেই।
‘উন্নয়নের করাত থেকে গাছেদের মুক্তি দাও’, ‘বেঁচে থাকা গাছ আপনার কী ক্ষতি করে’, ‘গাছ কাটার আগে আমাদের কাটো’—প্ল্যাকার্ডে এমন নানা স্লোগান লিখে আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় পরিবেশকর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন টাইগারপাসের দ্বিতল সড়ক হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের বড় একটি ছায়াবৃক্ষের নিচে। বিশাল শিরীষগাছটিতে ইতিমধ্যে নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের প্রয়োজনে গাছটি যে কাটা হবে, তারই চিহ্ন বহন করছে এটি। ওই মহিরুহ এই সড়কের ৪৬টি গাছ কাটার পরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। আর এমন পরিকল্পনার কথা জানাজানি হওয়ার পর গতকাল রোববার (৩১ মার্চ) রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন।
‘সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের’ ব্যানারে আয়োজিত এই বিক্ষোভ সমাবেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষজন যেমন এসেছেন, তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন পেশাজীবীরাও। বেলা দেড়টা পর্যন্ত শতবর্ষী শিরীষগাছের চারপাশে অবস্থান নিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন তারা। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান গাছ কাটার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন, তারা বিভিন্ন স্বার্থে কাজ করেন। আমরা বলছি আত্মঘাতী। সবার যদি এই আত্মঘাতী মনে হতো, তাহলে এ কাজটা করতে পারতাম না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমন সব লোককে ওপরে বসান, যাদের কোনো ট্রেনিং নেই। এই গাছগুলো থেকে নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকি এটা নিয়ে তারা অবহিত নন। প্রকৃতি থেকে যে আমরা নানা সুবিধা পাই, এসব নিয়ে তাদের জানাশোনা, জ্ঞান নেই। এসব জায়গায় যারা বসেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।’
সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশের ওপরের অংশে টাইগারপাস থেকে কদমতলী মোড় এবং নিচের অংশে কদমতলী থেকে টাইগারপাসমুখী সড়ক ‘দ্বিতল সড়ক’ হিসেবে পরিচিত। বৃক্ষরাজি ঘেরা নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার এ স্থানটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। সড়কের বিভাজক হিসেবে রাখা পাহাড়ের ঢালে প্রতিরোধক হিসেবে আছে শত-শত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, যার মধ্যে বেশিরভাগই রেইনট্রি। এর মধ্যে শতবর্ষী বৃক্ষও আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, র্যাম্প তৈরির কাজ পাওয়া সিডিএর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪৬টি গাছকে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছে। টাইগারপাসের পুলিশ বক্সের সামনে থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত এলাকায় গাছগুলোর অবস্থান।
এ বিষয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘র্যাম্প করতে হলে গাছগুলো কাটতে হবে। যেকোনো দিন গাছগুলো কাটা হবে। ওখানে কোনো শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৬টি গাছকাটার অনুমতি আমরা বন বিভাগ থেকে পেয়েছি। আর উন্নয়ন করতে গিয়ে যাতে পরিবেশ বা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে আমরা খেয়াল সবসময় রাখি। চেষ্টা করছি যত কম গাছ কাটা যায়।’
২০০৯ সালে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) সিআরবিকে হেরিটেজ এরিয়া বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত এলাকা ঘোষণা করেছিল সিডিএ। ড্যাপে সিআরবির কোনো অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না এবং সেখানে কোনো উঁচু স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে সিডিএ। হেরিটেজ এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংস্থাটির।
সিডিএ’র সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান জানান, ‘সিডিএ’র বিধিমালায় আছে, কোনো গাছের গোড়া অর্থাৎ মাটির নিচ থেকে ওঠা অংশের ব্যাস যদি এক ফুট বা তার চেয়ে বেশি হয়, সেই গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে না। কোনো ধরনের স্থাপনা করার জন্যও এ গাছ কাটা যাবে না। সিডিএ এখন নিজেরাই গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের বিধিমালা নিজেরাই লঙ্ঘন করছে।’
তিনি বলেন, ‘এই গাছ যদি অন্য কোনো সংস্থা কাটার উদ্যোগ নিত তাহলে সিডিএ অবশ্যই বাধা দিত। ২০১০ কি ১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অথবা সড়ক ও জনপথ বিভাগ একবার গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল। গাছগুলো মরে যাচ্ছে- এ অজুহাতে তারা কাটতে চাইলেও আমরা সিডিএর পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়েছিলাম। প্রকৃতির কী খেয়াল, তখন আবার গাছগুলোতে ডালপালা, পাতা গজাতে শুরু করে। তখন তারা আর সেগুলো কাটতে পারেনি।’
জানতে চাইলে সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এখানে কোনো বিধিমালায় লঙ্ঘন হচ্ছে না। প্রয়োজন পড়ায় সেখানে র্যাম্প নামাতে হচ্ছে। আর হেরিটেজ এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের। আমরা কেন বিধিমালা লঙ্ঘন করব!’
যে এলাকায় গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের আওতাধীন। সিডিএ সেই ভূমি বরাদ্দের জন্য রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ২৫ মার্চ সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে আগ্রাবাদ ও টাইগারপাস এলাকায় দু’টি র্যাম্প নির্মাণে ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে বিমানবন্দরমুখী আপওয়ার্ড র্যাম্প নির্মাণে ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও রেলওয়ের পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক থেকে দেওয়ানহাটমুখী আপওয়ার্ড র্যাম্প নির্মাণে ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের কথা বলা হয়। তবে সে চিঠির জবাব এখনও দেয়নি রেলওয়ে।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘সিডিএ যেখানে র্যাম্প করতে চাচ্ছে, সেখানে অনেক গাছ আছে। ওরা আমাদের কাছে আবেদন করেছে জায়গা চেয়ে। আমরা তাদের জায়গা দিতে পারি। আর তারা সেখানে গাছ কাটতে পারবে কি পারবে না সেটা পরিবেশ অধিদফতর বা বন বিভাগ মতামত দেবে। যদি দু’টি সংস্থা অনুমতি দেয়, তবেই র্যাম্প নির্মাণের সুযোগ পাবে সিডিএ।’
এদিকে, বন বিভাগ থেকে গাছ কাটার অনুমতি সনদ পেয়েছে সিডিএ। সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি রেইনট্রি কড়ই গাছ, চারটি ডিসি গাছ, দু’টি ইপিল, একটি কৃষ্ণচূড়া, তিনটি মেহগনি, একটি পেয়ারা গাছ কাটা হবে। এছাড়া ২৪টি অন্যান্য জ্বালানি গাছ কাটতে হবে।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জয়নাল আবেদীন জানান, ‘সিডিএ তাদের একটি প্রকল্পের স্বার্থে কয়েকটি ছোট গাছ এবং গাছের ডাল কাটার জন্য আমাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। ওখানে যেহেতু কোনো শতবর্ষী গাছ নেই, আর বড় গাছগুলোর শুধু ডাল কাটবে বলে উনারা উল্লেখ করেছেন, তাই আমরা তাদের অনুমতি দিয়েছি। প্রকল্পে শতবর্ষী দু’টি রেইনট্রি গাছের ডাল কাটতে হবে। বাকি গাছগুলো এখনো তেমন বড় হয়নি।’
২০২১ সালে পরিবেশবাদী সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়নের (ইকো) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতির, গুল্ম ৪১ প্রজাতি, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি এবং লতা জাতীয় ২২টি প্রজাতি রয়েছে। শুধু সিআরবি এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া যায় ১৮৩ প্রজাতির। নয়টি বিপন্ন প্রজাতিও সেখানে রেকর্ড করা হয়।
প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ‘সিআরবি এলাকায় বড় বড় যেসব গাছ আছে, এর অধিকাংশের বয়স ১০০ বছর কিংবা তার ওপরে। এ ধরনের গাছ নিছক একটি গাছ শুধু নয়। একেকটি গাছের মধ্যে কমপক্ষে ১০০টি অন্যান্য ধরনের উদ্ভিদ যেমন- শৈবাল, মস, অর্কিড, পরগাছা থাকে।’
গাছ কাটলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখন র্যাম্প করার জন্য গাছ কাটবে বলছে, সেখানেও আমরা অনেক বিপন্ন এবং ঔষধি উদ্ভিদ পেয়েছিলাম। বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেললে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের যে সমতা সেটিতে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সবকিছুতেই প্রভাব পড়বে। গাছের যে কার্বন আত্মীকরণ প্রক্রিয়া, সেটা ব্যাহত হবে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
এদিকে, সিডিএর গাছ কাটার সিদ্ধান্তের খবরে রোববার দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা হয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেন। এসময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত বক্তব্য দেন- মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. সিকান্দার খান, গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি, ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিটুল দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক স ম বখতেয়ার, গ্রিন ফিঙ্গারের আবু সুফিয়ান, কবি ফারহানা আনন্দময়ী, অগ্নিবীণা পাঠাগারের সৌরভ চৌধুরী এবং ক্ষুদিরাম পাঠাগারের রীপা মজুমদার।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ