সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও প্রতিনিধি: ‘অবৈধ বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বন্ধ করি। এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বুধবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে বিশ্ব হাতি দিবসের র্যালী ও আলোচনা সভা সম্পন্ন হয়েছে।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ ও মেদাকচ্ছপিয়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজনে, ইউএসএআইডির ইকো লাইফ প্রকল্প ও নেকম এর সার্বিক সহযোগিতায় এ দিবস পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা হুমায়ুন আহমেদ। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মেদাকচ্ছপিয়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদীন।
ইকো লাইফ প্রকল্পেরের সাইট অফিসার সিরাজুম মনিরের সঞ্চালনায় প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ইকো লাইফ প্রকল্পের এনআরএম ফ্যাসিলিটেটর সাইদুর রহমান।
ফাঁসিয়াখালী সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন এনআরএম ও ক্লাইমেট চেইঞ্জ ম্যানেজার মোঃ আব্দুল কাইয়ুম।
এছাড়া ফাঁসিয়াখালী সিএমসির কোষাধ্যক্ষ এলমুন্নাহার মুন্নী, মেদাকচ্ছপিয়া সিএমসির সহ-সভাপতি রাজিয়া সুলতানা, সাংবাদিক সেলিম উদ্দীন, পরিবেশ ক্লাবের সদস্য মরিয়ম জান্নাত, ইসমাম হোসেন, বন সংরক্ষন ক্লাবের মো: মোরশেদ, ইআরটির সদস্য আশরাফুল হাকীম, কিশলয় আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজমা সিদ্দিকা,খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ও মেদাকচ্ছপিয়া বিট কর্মকর্তা আলাউদ্দিন বক্তব্য রাখেন। এসময় বিভিন্ন স্কুল,পরিবেশ ক্লাব ও ইআরটি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভায় মেদাকচ্ছপিয়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের স্বীকার করতেই হবে, আমাদের হাতেই বন্য প্রাণির ভবিষ্যৎ। স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে হাতিই সবচেয়ে বড়। একটা সময় পৃথিবীজুড়ে কয়েকশ’ প্রজাতির হাতির বিচরণ থাকলেও কমতে কমতে তা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৪টিতে। এর মধ্যে ২টি আবার বিলুপ্তপ্রায়।
ফাঁসিয়াখালী সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাতির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু বনের উপর মানুষের অতি নির্ভরশীলতা, হাতির আবাসস্থল সংকোচন, বনে অবৈধভাবে বসবাস ও কৃষিকাজসহ নানা কর্মকান্ডের ফলে মানুষের সাথে হাতির সংঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্র একশ বছর আগেও যেখানে বিশ্বে হাতির সংখ্যা ছিল ১২ মিলিয়ন, সেখানে এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখে। প্রতি বছর শিকারিদের হাতে মারা যায় অন্তত ২০ হাজার হাতি।
বাংলাদশে বনবভিাগ ও আইইউসিএনের সর্বশেষ ২০১৬ সালের হাতি জরীপের তথ্যে, দেশে এশিয়ান বন্যহাতি রয়েছে ২৬৮টি । দেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩ পরিযায়ী হাতি বাস করে। সরকারী অনুমতিক্রমে দেশে পালিত হাতি রয়েছে ১০০টি। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ সংশোধন করে হাতির বাণিজ্যিক ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে এবং এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন বন্যপ্রাণির খাবার ও বসবাস যোগ্য বনায়ন সৃষ্টি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছনে তিনি।
সিএমসির কোষাধ্যক্ষ এলমুন্নাহার মুন্নী বলেন, হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নতুন আবাসস্থল তৈরি করতে হবে। বন্যপ্রাণী আমাদের প্রকৃতি রক্ষা করে, তাই আমাদের উচিৎ বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা করা। প্রতিনিয়তঃ মানুষরে সাথে হাতির সংঘাত বেড়ে চলছে। নিজের বাঁচার পাশাপাশি বন্যপ্রাণিতদরও প্রথিবীতে বাঁচার অধিকার রয়েছে। বন্যপ্রাণীর সাথে যেন সংঘাত না হয় সেদিকে সবার নজর থাকা দরকার। মানুষের সাথে হাতির সংঘাত বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতন হওয়া জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
ইকো লাইফ প্রকল্পের এনআরএম ও ক্লাইমেট চেইঞ্জ ম্যানেজার মোঃ আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, পাহাড় নিধন, অবৈধ গাছপালা কর্তন, বনাঞ্চল ধ্বংস, অবৈধ বসতি স্থাপন, কয়লা তৈরি, নগরায়ন, রেললাইন তৈরি ইত্যাদি কারণে ফাঁসিয়াখালী, মেদাকচ্ছপিয়া. হিমছড়ি ও টেকনাফ রক্ষিত এলাকায় হাতির স্বাভাবিক বসবাস ও চলাফেরা হুমকির সম্মুক্ষীন হচ্ছে নিয়মিত। ইকো লাইফ ও সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে বন বিভাগ ও নেকম সারা বাংলাদেশে ৭২টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) গঠন এবং তাদের প্রশিক্ষণ উত্তর ডিউটি সরঞ্জামের ব্যবস্থা করেছে। মানুষ এবং হাতির দন্দ্ব নিরসনে ৩০টি গণচেতনতামূলক সভা করেছে। এছাড়া প্রতি মাসে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) এর সভা ও বিশেষ টহল চালু রয়েছে।
তিন আরো বলেন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যাক্তি, ফসল, ঘরবাড়ী ইত্যাদি ক্ষতির জন্য সরকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। প্রজ্ঞাপন- ২৩ মার্চ, ২০২১- অনুযায়ী সরকারী বনাঞ্চলের বাহিরে ব্যাক্তি/প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ক্ষতির ক্ষেত্রে অনধিক ৫০,০০০/পঞ্চাশ হাজার টাকা; গুরুতর আহত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে অনধিক ১,০০,০০০/এক লক্ষ টাকা এবং মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৩,০০,০০০/তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। এই আইনের বিধান অনুযায়ী হাতি হত্যা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ। এরূপ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদন্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা। একই অপরাধ পূনরায় করলে সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানা। তিনি সবাইকে আইন মেনে বণ্যপ্রাণি রক্ষার আহবান জানান।
প্রধান অতিথি কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা হুমায়ুন আহমেদ বলেন, এবছরের বিশ্ব হাতি দিবসের প্রতিপ্রদ্য হচ্ছে- অবৈধ বন্যপ্রাণি বাণিজ্য বন্ধ করি। তাই হাতিসহ সকল বন্যপ্রাণির অবৈধ প্রাচার ও ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। হাতির দাঁত অনেক দামি বস্তু। এর জন্য আলাদা বাণিজ্যই হয়। বিভিন্ন দেশে তো বটেই, চীনে হাতির দাঁতের বাণিজ্য এতটাই বড় যে সেখানে স্বর্ণের বদলে হাতির দাঁত নেওয়া হয়। আর এই বিষয়টি হাতি শিকারের পেছনে অন্যতম কারণ। প্রাকৃতিক বাসস্থানের ক্ষতি হওয়ায় হাতিদের জীবন বিপন্ন।