নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে এক হাত থেকে আরেক হাতে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) স্লিপ বেচাকেনার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার টনের বেশি এলাচ বেচাকেনা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন মসলা ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা থেকে মুনাফা অর্জনের লোভে আবারও অস্থির করে তুলেছে এই মসলাপণ্যের বাজার।
এর আগে ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ না করে এক ব্যবসায়ীর গা-ঢাকা দেওয়ার পর অনেক দিন বন্ধ ছিল এ ব্যবসা। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফের চালু হয়েছে এ অবৈধ ডিও বেচাকেনা। এ ঘটনা অবশ্য খাতুনগঞ্জের জন্য নতুন কিছু নয়। অবৈধ ডিও লেনদেনের জন্য এই বাজার দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত।
ডিও হলো— পণ্য বিক্রির বিপরীতে দেওয়া ডেলিভারি অর্ডার। এলাচের ক্ষেত্রে ডিও ট্রেডিংয়ের মধ্যমে সাথে সাথে এলাচের ডেলিভারি না নিয়ে ভবিষ্যতে নেওয়ার জন্য মসলাটির কেনা-বেচার চুক্তি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা থেকে মুনাফা অর্জনের লোভে প্রায়ই বড় অঙ্কের চুক্তিতে যান। তাদের এই কারসাজিতে অস্থির হয়ে ওঠে এলাচের বাজার। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ী উভয়ই।
বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জের সোনামিয়া মার্কেটের নীচ তলায় শত শত লোকের ভিড়। কারো কাছে কোনো পণ্য মজুদ না থাকলেও তারা সবাই পণ্য বেচাকেনা করছেন। বাজারে আগন্তুক এসব লোকজন মূলত পণ্যের বদলে ডিও বেচাকেনা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি খাতুনগঞ্জে তেল, চিনি ও এলাচসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করেন। গত তিন-চার বছর ধরে তিনি এসব পণ্যের ব্যবসা করলেও তার কোনো দোকান বা অফিস নেই।
বুধবার তিনি কেজিপ্রতি ৩ হাজার ৩০০ টাকা দামে দুই টন এলাচ বিক্রি করেছেন। যা গত শনিবার ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে কিনেছিলেন তিনি। এতে গত চারদিনের ব্যবধানে তার মুনাফা হয়েছে ২ লাখ টাকা।
এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত চারদিনে কেজিতে ২০০ টাকা না বেড়ে উল্টো কমতে পারতো। ডিও ব্যবসা হলো অনেকটা জুয়া খেলার মতো। এখানে যেকোনো সময় পণ্যের দাম উঠা-নামা করে। ফলে লাভ-লসের ঝুঁকি বেশি।’
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, আগে তেল, গম, চিনিতে ডিও ব্যবসা হতো। এখন তেল, চিনিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে ডিও ব্যবসায়ীরা এলাচে বিনিয়োগ করছেন। এ সুযোগে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ডিও’র নামে শুধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে প্রতিদিন শত শত টন এলাচ কেনাবেচা করছেন।
ডিও যারা কেনাবেচা করছেন তাদের অনেকেই এসব এলাচের সত্যিকার মজুতের বিষয়েও জানেন না। পণ্যের চেয়ে টাকার বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এলাচের ডিও ব্যবসা ‘জুয়া খেলায়’ রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীরা। এসব ডিও ব্যবসার বৃহৎ অংশই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে সোনামিয়া মার্কেট থেকে।
এ বিষয়ে জানতে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ চাটগাঁ নিউজকে বলেন, ‘আমরা এর আগেও বহুবার খাতুনগঞ্জে এসব অবৈধ ডিও ব্যবসা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। এসব ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এটি এক ধরনের জুয়া খেলার মতো। তবে এ ব্যবসা নিয়ে অন্ধকারে পরে থাকলে চলবে না। কেবল ভোক্তা অধিকার নয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পণ্যের ডিও বিক্রি হয়। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা জানেন না এই পণ্য কোথায়। তেল, চিনি অথবা যেকোন একক পণ্য নিয়ে এসব কারবার চলতে থাকে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চরে যায়। এই ডিও বেচাকেনায় কোনো একটি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ হয়ে হঠাৎ বড় দরপতন হয়। খোঁজখবর নিয়ে আমরা আবারও এসব নিয়ন্ত্রণে কাজ করবো।’
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রায়ই ডিও ট্রেডিংয়ের বিষয়টি উত্থাপন করি। ভোক্তা ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে এ ধরনের ফটকা বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানাই।’
চাটগাঁ নিউজ/এআইকে/এসএ