নিজস্ব প্রতিবেদক : কত মন্ত্রী, এমপি এলো গেল। এই কালুরঘাট সেতু পাস করিয়ে আনতে পারেনি কেউ। অথচ কালুরঘাট সেতুর পাবলিক সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে রাজনীতিবিদরা গরম রেখেছেন রাজনীতির মাঠ। পার হয়েছেন নির্বাচনী বৈতরণী। কিন্তু সেতুর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল!
অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূসের হাত দিয়েই একনেকে পাস হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত আকাঙ্ক্ষিত কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু। এই অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে সারা দেশের সাথে কক্সবাজারের নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার।
সোমবার (৭ অক্টোবর) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ অধীন শেরে বাংলা নগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ২৪ হাজার ৪১২ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। চারটি প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রামেরই রয়েছে দুইটি প্রকল্প। একটি কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু, আরেকটি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। কালুরঘাট সেতুর প্রকল্প ব্যয় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অপরিবর্তিত ব্যয় বাজেটে অনুমোদন পেল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের সাথে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অনুমোদন সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার একটি। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালুর মাধ্যমে ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে এই রুটের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।
এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধছে চট্টগ্রামবাসী। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে তারা। মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর বিকল্প হিসেবে কর্ণফুলী নদীতে আরেকটি সেতু নির্মাণে সেই ২০১২ সালে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হয়। তখন কালুরঘাট সেতুর সংসদীয় এলাকা চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি। তিনি সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ছিলেন। তার মুখ দিয়ে কালুরঘাট সেতুর কথা শুনেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। তার পরে এই আসনের সংসদ সদস্য হয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত বাসদ’র এমপি মঈনুদ্দিন খান বাদল। কালুরঘাট সেতু নিয়ে এই ব্যক্তি সংসদে রীতিমত মুখে ফেনা তুলতেন। সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক কাঠখড় পোড়ালেও নতুন সেতুর অনুমোদন তিনি আর চোখে দেখে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর সেই আসনে এমপি নির্বাচিত হন দক্ষিণ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দুর্বলতা কালুরঘাট সেতু নিয়ে তিনিও কম গল্প শুনাননি। দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু সেতু আর হয়নি। মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুর পর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ। এরপর এই আসনের সংসদ সদস্য হন মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ সালাম। সবার মুখেই এই কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের গল্প শুনেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। কিন্তু কথায় তো চিড়ে ভিজে না; ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকার সেতুর নতুন নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা আগের প্রকল্প ব্যয়ের চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। বেশি ব্যয় বাজেটের কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পটি আর পাস করা হয়নি।
অবশেষে ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানাধীন জোবরা গ্রামের সন্তান। আর নতুন বাংলাদেশে চট্টগ্রামের ছেলে ড. ইউনূসের হাত ধরেই একনেকে চুড়ান্ত অনুমোদন পেল কালুরঘাট সেতু।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০৩০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ৭ হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ)। যাচাই–বাছাই করা হয়েছে; প্রকল্প ব্যয় আগের মতই (১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা) অপরিবর্তিত আছে।
প্রকল্পের ডিপিপি সূত্রে জানা গেছে, কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন একটি রেল সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকারি অর্থায়নে ২০১২ সালে এসএমইসি ও ডব্লিউআইইসিওএন কোং লিমিটেড এবং বাংলাদেশের এসিই কনসালটেন্ট লিমিটেড ও ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রস্তাবিত প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে।
সরকার সেতু নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানালে ইডিসিএফের নিয়োজিত পরামর্শক আগের ফিজিবিলিটির ভিত্তিতে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ৭ দশমিক ৬২ মিটার বিবেচনা নিয়ে ২০১৬ সালে পুনরায় প্রকল্পের ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে।
এ ফিজিবিলিটি স্টাডির আলোকে রেল কাম রোড সেতু নির্মাণের জন্য প্রণীত প্রকল্পের ডিপিপি ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটির অনুমোদন না দিয়ে সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়, প্রস্তাবিত সেতুর সড়ক ও রেল সেতুর জন্য আলাদা আলাদা ডিজাইন প্রণয়ন করে পুনরায় একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।
এ নির্দেশনা এবং পরে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট পয়েন্টে রেল কাম রোড সেতুর নির্মাণে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার রাখার জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেয়। এই নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ২ মিটার করার সিদ্ধান্ত হয়। নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার রেখে নতুনভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য ইডিসিএফের পক্ষ থেকে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর উশিন অ্যান্ড দোহা ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন জেভির সঙ্গে পরামর্শক চুক্তি সই করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালের মে মাসে চূড়ান্ত ফিজিবিলিটি স্টাডি দাখিল করে। ওই ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টের ভিত্তিতে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেলওয়ের ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন এবং দুই লেনবিশিষ্ট সড়কপথের সুবিধা রেখে রেল কাম রোড সেতু নির্মাণের ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়।
চাটগাঁ নিউজ/ উজ্জ্বল/এসএ