চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষদের একজন হায়দার আকবর খান রনো মারা গেছেন। প্রবীণ এই বামপন্থী নেতা শুক্রবার (১০ মে) রাত ২টা ৫ মিনিটে রাজধানীর পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জলি তালুকদার।
রাজনীতিবিদ ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো তীব্র শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ (টাইপ-২ রেসপিরেটরি ফেইল্যুর) নিয়ে গত ৬ মে সন্ধ্যায় পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলে এর আগে জানান হাসপাতালটির পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। অবস্থার অবনতি হওয়ায় হায়দার আকবর খান রনোকে হাসপাতালটির হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন দেওয়ার কথাও এক ফেসবুকে পোস্টে উল্লেখ করেছিলেন এই চিকিৎসক।
হায়দার আকবর খান রনোকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষদের একজন হিসেবে ভাবা হয়। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের কলকাতায়। তাঁর মায়ের নাম কানিজ ফাতেমা মোহসিনা ও বাবা হাতেম আলী খান। হায়দার আকবর খান রনোর একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ প্রয়াত হায়দার আনোয়ার খান জুনো।
মাঠে-ময়দানের সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা হায়দার আকবর খান রনো একাধারে একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক, তাত্ত্বিক ও লেখক। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। নটরডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তবে কারাবাসের কারণে তিনি অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি।
১৯৬১ সালে হায়দার আকবর খান রনো তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। পরবর্তী দীর্ঘ জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন বাঁক ও মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই সঙ্গে ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদী সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন। ১৯৬৯ সালেই তিনি এই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তখন থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন অন্যতম নেতা। ওই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি তিনিই প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানীন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রজীবন শেষে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন এবং টঙ্গী অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে বাস করে গড়ে তোলেন এক নতুন ধারার সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন।
হায়দার আকবর খান রনো ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের সৈনিক। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। রনো এই সকল ঘাঁটি অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতেন। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক।
হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার। তিনি চারবার কারাবরণ করেছেন, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। আইয়ুব আমল ও এরশাদ আমল- এই দুই আমল মিলিয়ে তাঁর বাসায় মিলিটালি ও পুলিশ রেইড করেছে অর্ধশতাধিকবার।
মৃত্যুকালে বামপন্থী রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তাঁর একমাত্র কন্যার নাম রানা সুলতানা এবং দুই নাতি- অরিত্র ও অন্তিক।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হায়দার আকবর খান রনো মার্কসবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) সংক্রান্ত বিষয়ে বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লেখেছেন। তিনি নিয়মিত কলাম লেখতেন। ২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর মোট বইয়ের সংখ্যা ছিল ২৫টি।
চাটগাঁ নিউজ/এসআইএস