উখিয়া প্রতিনিধি : সোমবার বিকেলে মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহতের পর থেকেই আতঙ্ক বেড়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত এলাকায়। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন জলপাইতলী, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, হিন্দুপাড়া, উত্তরপাড়া, মধ্যমপাড়া, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়ার বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে বালুখালী কাস্টমস থেকে পূর্ব দিকে এশিয়ান হাইওয়ে। এশিয়ান হাইওয়ের বেতবুনিয়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী এলাকা। এই এলাকার একটি টিলায় বাদশা মিয়ার বাড়ি। তাঁর বাড়িতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল পড়ে বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৫৫) ও তাঁদের বাড়িতে ধানখেতে কাজ করা রোহিঙ্গা শ্রমিক নবী হোসেন ((৬৫) নিহত হন। আহত হয় হোসনে আরার ছয় বছর বয়সী নাতনি নুশরাত মনি। সে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মর্টার শেলে নিহতের ঘটনার পর স্থানীয় গ্রামবাসী আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ দেলোয়ার বলেন, ‘এতদিন মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যে গুলি ও বোমার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল গত দুই-তিন দিনে এটি বেড়েছে। মানুষের বাড়িঘরের ছাদের উপরে গুলি, মর্টার শেলের খোসা পড়ছে। আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছাড়ছে এলাকাবাসী।’
নিহত হোসনে আরার পাশের বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান (৫০) বলেন, তার পরিবারের চার সদস্য নিয়ে উখিয়া সদরের আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এই মর্টার শেল তার বাড়িতেও পড়তে পারত। ভয়ে বউ-বাচ্চা কেউ থাকতে চাইছে না।
বেতবুনিয়া সড়কে বিকেল অবস্থান করে দেখা যায়, এক ঘণ্টায় জলপাইতলী গ্রামসহ আশপাশের আরও দুটি গ্রামের অন্তত ৫০টি পরিবার কাপড়চোপড় নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকে অন্যত্র যাচ্ছেন। জলপাইতলী গ্রামের ছালেহা বেগম (৪০) বলেন, মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর বাচ্চাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা কোনোভাবে ঘরে থাকতে চাইছে না। এ কারণে তাদের নিয়ে বালুখালী এলাকায় বোনের বাড়ি যাচ্ছেন।
বেতবুনিয়া বাজার এলাকার জমির উদ্দিন বলেন, মিয়ানমার থেকে কিছুক্ষণ পর পর মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে বাড়িঘরে। এ জন্য পরিবার নিয়ে কুতুপালং শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল হোসনে আরার বসতবাড়ির রান্নাঘরে এসে পড়েছে। এতে দুজন নিহত হন। এরপর গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। কেউ কেউ নিরাপদে থাকতে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ এলাকায় আছেনও।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষের রেশ বাংলাদেশের লোকালয়ে বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সীমান্তের ওপারে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে দেখা গেছে।
সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি
রোববার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বন্ধ ছিলও গোলাগুলি। সোমবার ভোর থেকে আবার গোলাগুলি শুরু হয়।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার শরীফুল ইসলাম জানান, কিছুক্ষণ পর পর মিয়ানমার সীমান্তে আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে গোলাগুলি হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, সীমান্তের ওপারে রাইট সাইট ও লেফট সাইট নামে দুটি প্রান্ত রয়েছে। জান্তা বাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর রাইট সাইট এখন আরাকান আর্মির দখলে চলে এসেছে সেটা এ পাশ থেকেই অনেকটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে লেফট সাইটে এখনো দুইপক্ষের মধ্যে চরম গোলাগুলি চলছে বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সীমান্ত এলাকা থেকে।
এমন অবস্থায় ঘুমধুম সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন।
পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকেও সীমান্তে জড়ো হতে দেখা গেছে। গণমাধ্যমকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো: মিজানুর রহমান।
অন্যদিকে আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে এ পর্যন্ত ৯৮ জন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি) সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদেরকে হেফজতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এ অবস্থায় সীমান্ত এলাকায় বিজিবিকে ধৈর্য্য ধরার জন্য বলা হয়েছে বলে সংসদে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি জানান সরকার যথাযথ সময় ব্যবস্থা নেবে।
একই দিন নিজ দফতরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রাণ বাঁচাতে আসা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তারা কোন পদ্ধতিতে যাবে, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে দুইপক্ষের মধ্যে। এখনই তৃতীয় কোনো দেশের সহযোগিতা নিচ্ছে না বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এরমাঝে আবারও নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় বাংলাদেশের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ