চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: গেল শুক্রবার (১৩ জুন) থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে হামলা-পালটা হামলা মঙ্গলবারও (১৭ জুন) অব্যাহত রয়েছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উভয়পক্ষের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির নতুন খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলার পর তেহরানও পালটা জবাব দিচ্ছে। হামলার তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। তবে, যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণ এবং আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় তাদের প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যা যা জানা গেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো-
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ক্ষয়ক্ষতি
হতাহত
ইরানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে, সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, কমপক্ষে ২২৪ জন ইরানি নিহত হয়েছেন। কোনো কোনো সূত্র মৃতের সংখ্যা ২২৮ জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে, যার মধ্যে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একজন কমান্ডারও রয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে নারী, পুরুষ এবং শিশুও রয়েছে। কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিহতদের ৯০ শতাংশের বেশি বেসামরিক নাগরিক। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া, এক হাজার ২৭৭ থেকে দেড় হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন।
তবে, মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে ইরান সরকারের দেওয়া মৃত্যুর সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ইরানি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ জানিয়েছে যে, তারা ৪০০ জনেরও বেশি নিহতের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ১৯৭ জন বেসামরিক নাগরিক।
পরমাণু স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি
স্যাটেলাইট চিত্র ও বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলি হামলায় ইরানের অন্তত দু’টি পরমাণু স্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। তবে, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ গভীর মাটির নিচে হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ পরিমাণ এখনো পরিষ্কার নয়। ইসরায়েল এই হামলায় ‘গুরুতর ক্ষতি’ হয়েছে বলে দাবি করলেও ইরান তা অস্বীকার করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকে সাইবার হামলা
তেহরানের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সেপাহ ব্যাংকে সাইবার হামলা হয়েছে। এ হামলা ব্যাংটির ডিজিটাল পরিকাঠামো অচল করে দেয় বলে জানিয়েছে দেশটির স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ফারস নিউজ এজেন্সি। ফলে ব্যাংকের অনলাইন সেবায় ব্যাপক বিঘ্ন ঘটে। হামলার পর ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন লেনদেন এবং ওয়েবসাইটে সেবাগ্রহীতারা প্রবেশ করতে পারছেন না।
আইআরজিসির শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা মঙ্গলবার (১৭ জুন) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েল দাবি অনুযায়ী তেহরানে হামলায় ইসলামিক রেভুল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দফতরের প্রধান আলী শাদমানিকে হত্যা করেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবন ক্ষতিগ্রস্ত
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে সম্প্রচার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে বর্তমানে তা পুনরায় শুরু হয়েছে। এই হামলাটি রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) ভবনে চালানো হয়েছিল।
১২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংসের দাবি ইসরায়েলের
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে যে, তারা ইরানের ৩০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। দখলদার সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা ৫০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের অন্তত ১২০টি নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে।
ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের গোয়েন্দাপ্রধান নিহত
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজের বরাত দিয়ে জানা গেছে, রোববার (১৫ জুন) দখলদার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের চৌকস ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) গোয়েন্দাপ্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং সামরিক বাহিনীর দুই জেনারেল নিহত হয়েছেন।
বিচার মন্ত্রণালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত
রোববার তেহরানের জনবহুল তাজরিশ ও কুদস স্কয়ার, শরিয়তি অ্যাভিনিউ এবং ভালিয়াসর স্কয়ারের হামলার বিচার মন্ত্রণালয় ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর ক্ষতিগ্রস্ত
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইসফাহানে অবস্থিত দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসফাহানের নিরাপত্তাবিষয়ক ডেপুটি গভর্নর আকবর সালেহি এই হামলার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে, এই হামলায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন আংশিক স্থগিত
ইসরায়েলি হামলায় আগুন লাগার কারণে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন আংশিকভাবে স্থগিত করেছে ইরান। রোববার (১৪ জুন) ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলার আশঙ্কায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ও মজুতকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত
স্যাটেলাইট চিত্র থেকে কেরমানশাহ ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র, শিরাজে ক্ষেপণাস্ত্র ও ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন কেন্দ্র, বিড কানাহ ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র এবং ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের প্রবেশপথগুলোতে ক্ষতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, যা ক্ষেপণাস্ত্র-সম্পর্কিত সরঞ্জাম লুকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। শহিদ মোদাররেস গ্যারিসন রকেট উৎপাদন কেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
তেহরানের রাস্তায় বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করছে।
ইরানের পালটা হামলায় ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি
হতাহত
ইরানের পালটা হামলায় ইসরায়েলে হতাহতের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেওয়া হচ্ছে। তবে, ইরানের দাবি অনুযায়ী ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে নিহতের সংখ্যা ৫০ জন বলেও জানা যাচ্ছে। তবে ইরানপন্থী গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে সংখ্যাটি ৫০০-এর কম নয়।
এ ছাড়া, ইসরায়েলি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আহত অবস্থায় প্রায় ৩০০ থেকে ৬০০ জনের বেশি মানুষকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিছু সূত্র আহতের সংখ্যা এক হাজারের বেশি বলেও দাবি করছে।
সামরিক গবেষণার কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত
মধ্য ইসরায়েলের রেহোভোতে অবস্থিত ওয়েইজম্যান বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। বহু বছর ধরে এটি ইসরায়েলের সামরিক গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সোমবার (১৬ জুন) রাতে ইরানের এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৪টি এফ-৩৫ ধ্বংস
মঙ্গলবার তাবরিজ শহরের আকাশে ভূপাতিত হয়েছে ইসরায়েলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। এটি ছিল ইরানের হাতে ধ্বংস হওয়া চতুর্থ এফ-৩৫। বিশ্বের সর্বাধুনিক ও স্টেলথ প্রযুক্তিসম্পন্ন এ যুদ্ধবিমানকে গর্ব করে ‘অদৃশ্য ঘাতক’ বলে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
সামরিক গোয়েন্দা স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) গোয়েন্দা শাখার স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। আইআরজিসি’র ভাষ্যমতে, তাদের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র এবং মোসাদের একটি অপারেশন পরিকল্পনা কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে আঘাত হেনেছে।
ড্রোন তৈরির কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, সোমবার (১৬ জুন) ইরানি কর্তৃপক্ষ রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি ড্রোন তৈরির কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি করেছে।
তেল পরিশোধনাগার বিধ্বস্ত
সোমবার (১৬ জুন) রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দখলদার ইসরায়েলের হাইফায় অবস্থিত বৃহৎ তেল পরিশোধনাগারটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তেল পরিশোধনাগার পরিচালনাকারী বাজান গ্রুপ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে তাদের সমস্ত অবকাঠামো বন্ধ হয়ে গেছে। বিবৃতিতে আরও নিশ্চিত করা হয়েছে, এই হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন।
তেল আবিবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিন দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত
ইরান ইসরায়েলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কাছাকাছি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি এক এক্স পোস্টে জানিয়েছেন, এই হামলায় ভবনের সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
তিনটি বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত
ইরান রোববার (১৫ জুন) ইসরায়েলের বন্দরনগরী হাইফা, তেল আবিব এবং নেগেভ বিমানঘাঁটিতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ওইসব এলাকায় আগুন ধরে যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইসরায়েলি উদ্ধারকারী সংস্থা জাকা জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সেখানকার একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ড্রোন ও কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত
ইরানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার আহমাদ আলি জানিয়েছেন, ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশের চেষ্টাকালে ৪৪টি ইসরায়েলি ড্রোন ও কোয়াডকপ্টার গুলি করে নামানো হয়েছে।
উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ক্ষতিগ্রস্ত
আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় শহর রেহোভোটে অবস্থিত গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি স্থাপনা নষ্ট হয়েছে।
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ