চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। কনস্যুলেটে হামলা চালানোর কথা স্বীকার না করলেও এই আক্রমণের পিছনে যে ইসরায়েল রয়েছে এমনটা মনে করা হচ্ছে।
এই প্রথম ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালিয়েছে ইরান।
এর আগে অবশ্য ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তারা। দায় স্বীকার না করে একে অপরের সম্পদের ওপর হামলা চালিয়েছে দুই দেশ। এই আক্রমণের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে।
ইরান এবং ইসরায়েলের যাদের এক সময় সুসম্পর্ক ছিল তাদের এই ‘সম্মুখ-সমর’ পুরো বিশ্বের কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে একাধিক বিষয়। যেমন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্র গোষ্ঠী এবং তাদের সঙ্গে ইসরায়েলের সমীকরণ, বিশ্বের অন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক-সহ বিভিন্ন বিষয়।
ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা কেন?
ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই দুই দেশ মিত্র ছিল। তারপর ইরানে এমন একটি শাসনব্যবস্থা আসে যারা ইসরায়েল বিরোধিতাকে আদর্শের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে।
ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকেই স্বীকার করতে চায় না ইরান। উল্টো তাদের নির্মূল করতে চায়।
দেশটির শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এর আগে ইসরায়েলকে ‘ক্যান্সার যুক্ত টিউমার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। একই সঙ্গে বলেছিলেন ওই দেশকে ‘নিঃসন্দেহে নির্মূল ও ধ্বংস করা উচিৎ’।
ইসরায়েল মনে করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ইরান একটা বড় ঝুঁকি। তার প্রমাণ হিসাবে রয়েছে তেহরানের বাগাড়ম্বর, ইসরায়েলকে ধ্বংসের করতে বদ্ধপরিকর প্রক্সি বাহিনী গঠন করার মতো ঘটনা, হামাস ও লেবাননের শিয়া জঙ্গি গোষ্ঠী হেজবুল্লাহসহ সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলিকে অর্থায়ন ও অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া এবং সর্বোপরি চুপিসারে পারমাণবিক অস্ত্রে ইরানের বলীয়ান হওয়ার চেষ্টা। ইরান যদিও পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্রদেশ কারা?
মধ্যপ্রাচ্যে মিত্র গোষ্ঠী ও প্রক্সি বাহিনীর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ইরান। তাদের দাবি সেটি ওই অঞ্চলে মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করতে গঠিত একটি ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ অংশ। বিভিন্নভাবে ইরানকে সমর্থন করে থাকে এই নেটওয়ার্ক।
এদিকে ইরানের মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সিরিয়া। সেখানে এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের মাঝে বাশার আল আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার পাশাপাশি সহায়তা করেছে ইরান।
ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো লেবাননের হেজবুল্লাহ। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আন্তঃসীমান্তে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি চলছে। সীমান্তের দু’দিক থেকেই হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক বাধ্য হয়েছেন তাদের বাড়িঘর ছাড়তে।
বেশ কয়েকটি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে ইরান সমর্থন করে। সিরিয়া ও জর্ডানে থাকা মার্কিন ঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে এইসব গোষ্ঠী। জর্ডনে একটি সামরিক চৌকিতে মোতায়েন থাকা তিন মার্কিন সেনার মৃত্যু ও এর পাল্টা জবাব দিতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
ইয়েমেনের হুথি আন্দোলনকে সমর্থন করে ইরান। যারা দেশটির সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
প্রসঙ্গত, গাজায় হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনের জন্য হুথিরা ইসরায়েলকে নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়েছে। শুধু তাই নয়, উপকূলের কাছে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে একটি জাহাজকেও ডুবিয়ে দিয়েছে।
পাল্টা জবাব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। হুথিদের নিশানায় রেখে হামলা চালিয়েছে তারা।
হামাস-সহ সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং প্রশিক্ষণ দেয় ইরান। হামাস গত বছরের সাতই অক্টোবর ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়েছিল যা গাজায় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। একই সঙ্গে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতেরও সৃষ্টি করেছে যেখানে জড়িয়ে পড়েছে ইরান, তাদের প্রক্সি ও ইসরায়েলের মিত্র গোষ্ঠীও।
তবে সাতই অক্টোবরের হামলায় কোনও ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করেছে ইরান।
প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল ইরান
গত শনিবার রাতে ইসরায়েলের উপর বিমানপথে বোমা হামলার কারণ জানিয়েছে ইরান। তাদের দাবি, পহেলা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলায় তাদের (ইরানের) সিনিয়র কমান্ডারদের মৃত্যুর জবাবে এই আক্রমণ।
ইরানের অভিযোগ বিমান আক্রমণ চালিয়ে সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল। যদিও এই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরায়েল। তবে তারাই যে ওই হামলার নেপথ্যে রয়েছে এমনটাই মনে করা হয়।
আকাশপথে চালানো এই আক্রমণে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের তালিকায় ছিলেন ইরানের অভিজাত রিপাবলিকান গার্ডের (আইআরজিসি) বৈদেশিক শাখা কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ রেজা জাহেদীও।
ইরানের তরফে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহকে অস্ত্র জোগাতে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ রেজা জাহেদী।
সিরিয়াতে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে চালানো হামলা একটা নির্দিষ্ট ‘প্যাটার্ন’কে অনুসরণ করে। যেমনটা ঠিক ইরানকে নিশানায় রেখে ইসরায়েলের আক্রমণের সময় দেখা যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সিরিয়াতে বিমানহানায় আইআরজিসি’র একাধিক প্রবীণ কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছে।
সিরিয়া মারফৎ হেজবুল্লাহর কাছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রসহ অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে ইরান। এই সরবরাহ বন্ধ করতে চেয়েছে ইসরায়েল। এর পাশাপাশি ইরান যাতে সিরিয়ায় মজবুত সামরিক উপস্থিতি না রাখতে পারে সেই বিষয়টাও নিশ্চিত করতে চেয়েছে তারা।
ইরান ও ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে?
ইসরায়েলের কাছে নিজস্ব পারমাণবিক হাতিয়ার রয়েছে বলেই মনে করা হয় যদিও এই বিষয়টাকে অস্পষ্ট রাখার নীতি তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই মেনে চলে।
ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নেই। আর পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যবহারের চেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার করে তারা।
যদিও গত বছর বিশ্ব পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইরানের ভূগর্ভস্থ ফোরদো সাইটে ৮৩.৭ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম কণা খুঁজে পেয়েছিল, যা ‘উইপন গ্রেড’ (অস্ত্র-গ্রেড পারমাণবিক উপাদান)-এর খুব কাছাকাছি। ইরান অবশ্য দাবি করেছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রায় ‘অনিচ্ছাকৃত ওঠানামা’ ঘটে থাকতে পারে।
বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষর হওয়া ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘন করে ইরান দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।
তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে ২০১৮ সালে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার পর এটি ভেস্তে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। প্রসঙ্গত ইসরায়েল কিন্তু প্রথমেই পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
আক্রমণের মাধ্যমে কী বার্তা পাঠাতে চায় ইরান?
“আমরা প্রতিহত করেছি। আমরা বাধা দিয়েছি। একইসঙ্গে আমরা জয়ী হব,” ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিষয়টিকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবেই।
তবে যুক্তরাজ্যের একাধিক প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ও লেবাননে যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত টম ফ্লেচার বলেছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কিন্তু তাদের ‘সক্ষমতা ও নাগালের সংকেত’ যা ‘ভয় দেখানোর মতো’।
একই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ার করে জানিয়েছেন ইরান ও ইসরায়েল নেতারা “নিজেদের দেশে চাপের মুখে রয়েছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে এবং স্পষ্টতই তারা আগুন নিয়ে খেলতে প্রস্তুত।”
তবে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন ইরানের নজিরবিহীন আক্রমণ সতর্কতার সঙ্গে তৈরি একটা পরিকল্পনা।
এই আক্রমণকে লেবাননে রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন তিনি যে গুলি বিনিময় দেখেছিলেন তার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “ইরান আগে থেকে আক্রমণের কথা টেলিগ্রাফ করেছিল যার ফলে সেটা রুখে দেওয়ার কাজ সহজ ছিল” এবং সেখানে “উদ্দেশ্য ছিল সক্ষমতা প্রদর্শন করা কিন্তু বিষয়টিকে বাড়িয়ে তোলা নয়।”
তিনি আরও জানিয়েছেন এই বিষয়টা ‘ইতিবাচক’ যে ইরান হেজবুল্লাহর মাধ্যম করার পরিবর্তে সরাসরি জবাব দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের অনেকেই সীমান্ত থেকে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সরিয়ে ফেলতে সামরিক বাহিনীকে সংঘাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
চ্যাথাম হাউস থিঙ্ক ট্যাংকের সানাম ভাকিল বলেছেন, “এই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।”
“এই আক্রমণ স্পষ্টতই সতর্কতার সঙ্গে পরিমাপ করে নেওয়ার পরই করা হয়েছে যার নিশানায় ছিল সামরিক স্থাপনা। এবং আক্রমণের ফলে যেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি না হয়, বা কেউ আহত না হয় সেটা নিশ্চিত করা হয়েছিল।”
চাটগাঁ নিউজ/এসএ