চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : ছাত্র জনতার আন্দোলনকে ঘিরে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ করতে গিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটক ৫৭ প্রবাসী বাঙালির বাইরে আরও হাজারো বাঙালি সেদেশের কারাগারে আটক আছে বলে দাবি করেন মুক্তিপ্রাপ্ত তিন প্রবাসি।
মুক্তির পর দেশে ফিরে গত বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় সিপ্লাসটিভিতে এসেছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের দুজনসহ তিন রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
এর আগে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা ঘোষণা করেন দেশটির রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম দফায় ১৪ জন, পরে আরও ৪০ জনসহ মোট ৫৭ বাংলাদেশি দেশে ফিরেন। তাদের মধ্যে তিন প্রবাসী সিপ্লাসটিভিতে হাজির হয়ে কারাগারে থাকা দিনগুলোর দুঃসহ কষ্ট ও স্মৃতি তুলে ধরেন।
তারা হলেন- রাউজান উপজেলার জিয়াউল হক, ইসকান্দার হোসেন ও কোম্পানিগঞ্জের সাইদুল হক। তারা সকলে কারাগারে থাকা দিনগুলোর দুঃসহ কষ্ট ও স্মৃতি তুলে ধরেন।
সিপ্লাসটিভির প্রধান সম্পাদক আলমগীর অপুর সঞ্চালনায় এক টকশোতে অনাকাঙ্ক্ষিত কারাবরণের জন্য তারা ৩ জনই দুষলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে।
তারা বলেন, সে সময় তিনি সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে বরং দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের সাজা দেওয়ার বিষয়টি প্রভাবিত করেন। সাজাপ্রাপ্তদের আত্মীয়-স্বজনরা সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট ধরনা দিয়েও কোন সাড়া পাননি। অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আটক ও দণ্ডিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুক্তির বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করার ফলে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করেছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি।
কোম্পানিগঞ্জের সাইদুল ইসলাম বলেন, কারাগারে আমাদের এক রুমে ৩২ জনকে রাখা হয়েছে, যেটি ১৫-১৫ বর্গফুটের হবে। এক রুমে উপরে নিচে সিট ছিল ১০টি। উপরের সিটে একজন করে, নিচের সিটে ২-৩ জন করে থাকতে হতো। বাকিরা সকলে ফ্লোরে থাকতো। বাথরুম ছিল ২টি, বেসিন ছিল ২টি। তখন বুঝতে পেরেছি খাবারের কষ্ট কী, কাপড়ের কষ্ট কী।
তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন, যে খাবার আমরা অপচয় করতাম, সে খাবার আমাদের খুঁজে খেতে হয়েছে। এক কাপড়ে ১২ দিন থাকতে হয়েছে। বাহির থেকে রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা একটি কাপড় ছুঁড়ে দিলে সকলে তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো।
ইসকান্দার হোসেন বলেন, আমরা সবসময় মানুষকে যে খাবার এমনি খাইয়েছি, সে খাবার আমরা কারাগারে গিয়ে খুঁজে খেয়েছি। সে দেশের ফেলে দেওয়ার উপযোগী খাবার আমরা খুঁজে খেয়েছি। সকালে একটা রুটি আর সামান্য মাখন দিত, দুপুরে ভাত আর সন্ধ্যায় একটি রুটি দিত। সপ্তাহে ২ দিন রোজা রাখতাম আমরা। আজ রাজা কাল ফকির এমন প্রাবাদ বাক্যের মতো আমাদের জীবন হয়ে গেছে। কারাগরে শুধু ৫৭ জন নয়, হাজারো বাংলাদেশি আটক আছে। যা আমরা নিজ চোখে দেখেছি।
মুক্তিপ্রাপ্ত প্রবাসী রাউজানের সন্তান জিয়াউল হক জিসান বলেন, যখন শুনলাম আমার ১০ বছরের সাজা, সে সময় সম্পূর্ণ এসি রুমে আমি ঘামতে থাকি। সকলে হুহু করে কেঁদে ফেলে। ২২ বছরের এক ছেলে ছিল যাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে। সে বিয়ে করেনি, জীবন আরও বাকি রয়েছে। আমাদের সাথে ৭০ বছরের একজন ৬৫ বছরের একজন বয়োবৃদ্ধ লোক ছিল। সবার মনে কি যে অবস্থা তা বুঝানো যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বাড়িতে আমার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, আমি আমার পরিবারের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমরা সকলে পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। হঠাৎ এক পাকিস্তানি কয়েদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বাংলাদেশের ইউনূস কে? আমি বললাম উনি নোবেল বিজয়ী আমাদের দেশের গর্ব, বিশ্বব্যাপী পরিচিত মানুষ। তখন সে আমকে বললো, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নিয়েছে। তখন আমি তা শোনার পরপর শুকরিয়া আদার করলাম। মনের মধ্যে আশার সঞ্চার করলাম যে, আল্লহর রহমতে এবার যদি মুক্তি পাই কারাগার থেকে।
তিন প্রবাসীর কষ্টের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেন সিপ্লাস টিভির প্রধান সম্পাদক আলমগীর অপু। তিনি জানতে চান, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আপনারা কি চান? তখন তারা একসাথে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চেষ্টা করলে আমরা আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফেরত যেতে পারি। সেখানে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু গোছানো আছে। আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যেতে পারবো। আমাদেরকে সরকার পুনর্বাসন করলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
আলমগীর অপু বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আমেরিকার ভালো সম্পর্ক আছে। উনি যদি আপনাদের আমেরিকার ভিসা ম্যানেজ করে দেন তাহলে কেমন হয়? তখন তারা বলে ওঠেন- আলহামদুলিল্লাহ। ভালো হয়।
উল্লেখ্য, জুলাইয়ের বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ আঁছড়ে পড়েছিল সূদুর প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আটক ও দণ্ডিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুক্তির বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ফলে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করেছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
চাটগাঁ নিউজ/এআইকে/এসএ