‘আমাদের রিজিক কেড়ে নিয়ে এখন আপনারা কী শান্তি পাচ্ছেন’!
ইসলামী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের সংবাদ সম্মেলন

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: ইসলামী ব্যাংক থেকে চাকরি হারানো কর্মকর্তাদের সংবাদ সম্মেলন ছিল আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) সকালে। সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার চেয়ে বরং তাদের কান্না এবং আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে পরিবেশ।

এ সময় কেউ অঝোরে কাঁদতে থাকেন, কেউ ছিলেন বাকরুদ্ধ, কেউ আবার অসহায়ের মতো কেবল তাকিয়েই ছিলেন সংবাদ কর্মীদের মুখপানে।

তবে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের কানে বারবার টোকা দিচ্ছিল তানজিনা আফরোজ নামে এক নারী কর্মকর্তার একটি কথা— ‘আমাদের রিজিক কেড়ে নিয়ে আপনারা কী শান্তি পাচ্ছেন! আমাদের দীর্ঘশ্বাস আপনাদের ওপর সবসময় থাকবে।’

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন চাকরি হারানো কয়েকশত কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এসময় ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের চৌধুরীহাট শাখার জুনিয়র অফিসার পদ থেকে চাকরিচ্যুত হওয়া তানজিনা আফরোজ জানান, বছরখানেক আগে তার মা এবং আট মাস আগে তার ব্যবসায়ী স্বামী স্ট্রোক করে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ঘরবন্দি পড়ে আছেন। ব্যাংকের চাকরির আয় দিয়ে অসুস্থ মা ও স্বামীর চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি সংসার ও দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি একাই।

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলতে থাকেন— ‘আমার দুইটা বাচ্চা, আমি গত পরশু তাদের স্কুলে গিয়ে টিচারকে বললাম যে, আমি তো সামনের মাস থেকে আর বেতন দিতে পারবো না। আমার হাজবেন্ড, আমার মা স্ট্রোক করে এখন বাসায়। সবার দায়িত্ব এখন আমার ওপর। এখন আমার চাকরিটাই যে নাই, আমি কী করবো!’

‘ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বলছি- রিজিকের মালিক তো আল্লাহ, আমাদের রিজিক কেড়ে নিয়ে আপনারা কী শান্তি পাচ্ছেন! আমি যেদিন টারমিনেশন লেটার নিয়ে এসেছি, সেদিন আমি বলেছি-স্যার আমাদের দীর্ঘশ্বাস আপনাদের ওপর সবসময় থাকবে। আমরা অনেক অসহায়, আমাদের পরিবার অনেক অসহায়।’

তানজিনা আরও বলেন, ‘সাত বছর চাকরি করার পর কেন আমাদের অদক্ষ, অযোগ্য বলে আমাদের পুরো পরিবারের রিজিকে উনারা লাথি দিল? আমরা অযোগ্য হলে তো আমাদের নিয়োগ হতো না। সব প্রক্রিয়া মেইনটেইন করেই তো আমাদের নিয়োগ হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বরখাস্ত কর্মকর্তা এস এম এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সাড়ে চার হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত টারমিনেট করা হয়েছে। সবার অ্যাকাউন্টই ফ্রিজ করা হয়েছে। সবাই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে আমাদের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দলের চিহ্নিত কর্মীদের দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তারা আমাদের সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। গত সপ্তাহে ছয় দফা দাবি দিয়ে আমরা এক সপ্তাহ ধৈর্য্য ধরেছি। ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।’

ইসালামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য করবেন না। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্যে আমাদের শ্রম ও ঘাম আছে। আমরা চাই না ব্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যাক। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে আমরা পথে নামতে বাধ্য হব। তখন আপনারা পালানোর পথ পাবেন না।’

প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে এমদাদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা– আপনি চট্টগ্রামের সন্তান। চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ থামাতে আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর এই নতুন বাংলাদেশে এমন বৈষম্য আমরা মেনে নিতে পারি না।’

উল্লেখ্য, দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি নিয়ন্ত্রণে নেয় এস আলম গ্রুপ, যেটি আগে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে।

এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির টাকা লুটপাটের পাশাপাশি নিজ এলাকা পটিয়াসহ চট্টগ্রামের লোকদের গণহারে নিয়োগের অভিযোগ ছিল। নতুন পর্ষদ আসার পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তার বিশেষ সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেয় ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে জানানো হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে এস আলমের আমলে নিয়োগ পাওয়া চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির ফাঁদ পাতার অভিযোগ তুলে তারা পরীক্ষা বর্জন করেন। পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর কর্মস্থলে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, পরীক্ষা বর্জনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ হাজার ৫০০ এর বেশি কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ

Scroll to Top