নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম নগরীর ‘জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে’ ১১ বছরে ৪৮ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। তবে গত এক বছরে লুটপাট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হওয়ায় ৬০ শতাংশ আয় বেড়েছে দাবি পরিচালনা কর্তৃপক্ষের।
মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে নগরীর আন্দরকিল্লায় রেড ক্রিসেন্ট পরিচালিত জেমিন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দিয়েছেন রেড ক্রিসেন্টের চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের অধীন ৬টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করে দিয়েছিলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১১ বছরে জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে প্রায় ৪৮ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এখানে বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয় ও আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। একই জিনিস বারবার ক্রয় করা হতো।’
এটিএম পেয়ারুল ইসলাম জানান, এই হাসপাতালে বিগত সময়ে একটি বালিশ কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। বছরে গড়ে ৩০ লাখ টাকার বিছানার চাদর, ফোম-মেট্রেস, জানালার পর্দা কেনা হয়েছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর দেখতে পায়, সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এরপর মাত্র সোয়া ৩ লাখ টাকায় একই জিনিস কেনা হয়েছে। দেখা গেছে, কোনো দরপত্র প্রক্রিয়া বা ক্রয়নীতি অনুসরণ না করে হাসপাতালের জন্য ইলেকট্রিক ও স্যানিটারি সামগ্রী কেনা এবং মেরামতের নামে প্রতিবছর গড়ে ৯০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রোগীদের ব্যবহারের জন্য গ্লাভস, কটন ও থানগজ কেনায় প্রতিবছর খরচ করা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। গাড়ি মেরামত ও জ্বালানির নামে প্রতিবছর ২৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের জেনারেটর, ২টি মাইক্রোবাস ও একটি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য প্রতিদিন ২০০ লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হতো। কোনো ধরনের লগবই ব্যবহার ছাড়াই জ্বালানি তেল ও মেরামতের নামে অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। আপ্যায়নের নামে বছরে টাকা খরচ করা হতো ১০ লাখ।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান পেয়ারুল আরও বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর আপ্যায়ন খরচ বছরে ৭৫ হাজার টাকায় নামিয়ে এনেছি। গাড়ি মেরামত ও জ্বালানি খরচ বছরে মাত্র ৪ লাখ টাকা, রোগীদের জন্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় বছরে খরচ ১০ লাখ টাকাসহ আরও বিভিন্ন খাতে খরচ অর্ধেকেরও কমে নামিয়ে আনা হয়েছে। ডাক্তারদের আনা-নেয়ায় ১৫ লাখ টাকা বছরে সাশ্রয় করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আগে প্রতিমাসে আয় ছিল ৫৫ লাখ টাকা। সেটা এখন ১ কোটি ৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একবছর আগে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ৮ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া ছিল। এখন নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধের পাশাপাশি ৬ মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান পরিচালনা পরিষদ দায়িত্ব নেয়ার পর আয় বেড়ে ৭ কোটি টাকা থেকে ১১ কোটি টাকা হয়েছে। বছর শেষে মোট আয় ১৫ কোটি টাকা হবে। এছাড়া অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ৮ কর্মচারিকে তদন্তপূর্বক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর পদাধিকারবলে রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম ইউনিটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। এর আগপর্যন্ত ১১ বছর দায়িত্বে ছিলেন বিদায়ী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পেয়ারুল বলেন, ‘উনাকে (এম এ সালাম) একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা জানি। তিনি নিজেই একটি পত্রিকায় সাক্ষাতকারে বলেছেন, জেলা পরিষদ এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের কারণে তিনি রেড ক্রিসেন্টে সময় দিতে পারেননি। কিন্তু যিনি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে এখানে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেছেন, তার বিষয়ে আমরা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কেন্দ্রকে জানিয়েছি। অবশ্যই দুর্নীতির বিচার হবে।’
ওই কর্মকর্তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি ডাক্তার শেখ শফিউল আজম বলে উল্লেখ করেন। যিনি তার মেয়ে, ভাতিজা, গৃহকর্মীসহ ৮ স্বজনকে নিয়োগ দেন বলেও অভিযোগ করেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম।
জানা গেছে, রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম নগরে ৬টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। সেগুলো হলো- জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, রেডক্রিসেন্ট প্যাথলজি সেন্টার, এইচএসবিসি রেড ক্রিসেন্ট থ্যালাসেমিয়া রিচার্স সেন্টার, ফাতেমা বেগম রেড ক্রিসেন্ট রক্তকেন্দ্র, জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট নার্সি ইনস্টিটিউট এবং জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট জুনিয়র মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউট।
রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সোসাইটির নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদসহ অন্য সদস্যরা।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ