চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, আমরা চাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার। সাধারন মানুষের ধারণা, নির্বাচিত সরকারের চেয়ে অনির্বাচিত সরকার বেশি সু-শাসন দিতে পারে।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীস্থ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
জিএম কাদের আরও বলেন,নির্বাচনী রোডম্যাপ বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা অনেকবার আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু আমরা দেখেছি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেনি। কারণ হচ্ছে, আমাদের সংবিধানে নানা ধরণের ত্রুটি আছে। যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে শুধু নির্বাহী বিভাগ নয়, সংসদ প্রায় শতভাগ এবং বিচার বিভাগের ৯৫ থেকে ৯৯ ভাগের নিয়ন্ত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোাতে নিজেদের লোক নিয়োগ করে সম্পূর্ণ দলীয়করণের ক্ষমতা দেওয়া আছে। আমরা চাই নির্বাচন ব্যবস্থা এবং শাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠু করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে ৮ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। যে নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু, ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের শেষ বছর বাংলাদেশ দূর্ণীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একইভাবে র্যাব দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও দূর্ণীতি দুঃশাসনে দেশের মানুষ অস্থির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে পরপর চারবার দেশ দূর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়ও নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দলীয়করণের চেষ্টা হয়েছিল।
আমরা দেখতে পেরেছি জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করে না। নির্বাচিত সরকার পরবর্তী নির্বাচনকে কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করে। আমরা চাই বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার একটি গ্রহণযোগ নির্বাচন দিতে সমর্থ হবে। যাতে, পরবর্তীতে দেশের মানুষকে আর ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করতে না হয়। নির্বাচন কমিশন যেন সকল দলের কাছে গ্রহণ হয়। সেজন্য আইনগতভাবে স্থায়ী সমাধান করতে হবে। সরকার চাইলে, এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত প্রস্তাবনা দেব। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হতে হবে বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংসদে ও সংসদের বাইরে আনুপাতিকহারে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই এই ব্যবস্থায় নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করার পরে জাতীয় নির্বাচনে আগে সরকার যেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো দেন। তাহলে বোঝা যাবে, নির্বাচন পদ্ধতি সঠিক আছে কিনা। আইন পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিতে হবে। সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
এক ব্যক্তি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে তার মধ্যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চিন্তা আসে। তাই, আমরা চাই কোন ব্যক্তি যেন দুইবারের বেশী প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একেবারে শূন্য করা হয়েছে। আমরা চাই, সংসদে চার ভাগের তিন ভাগ ভোটে যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়, তাহলে যেকোনো সরকার প্রধান তাকে যখন তখন অপসারণ করতে পারবে না। এখন প্রায় সকল ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করতে হয়, আমরা এর বাতিল চেয়েছি। আমরা চাই, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্রপতি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিবেন। আমরা চাই, রাষ্ট্রপতি তার জায়গা থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
নিম্ন আদালত রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। সংবিধানের ১১৬ ধারা বাতিল করা উচিত। নিম্ন আদালতের ব্যাপারে সব ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে দেওয়া উচিত। উচ্চ আদালতের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দিবেন। কিন্তু, তা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে পাশ হতে হবে। একইসাথে নির্বাচন কমিশনার যারা নির্বাচিত হবেন তাদের মিনিমাম একটা কোয়ালিটি নির্ধারণ করতে হবে আইনের মাধ্যমে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রেখে কোন সংশোধন করা সম্ভব নয়। তাই, সংবিধান সংশোধন করতে হলে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে। অথবা, নতুন করে সংবিধান রচনা করতে হবে। মামলা করলে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ হতে পারে। সংবিধানের কিছু অংশ পরিবর্তন করা যাবে না এটা কখনই হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, দ্রুত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। পুলিশের ভয়-ভীতি দূর করে তাদের মাধ্যমে মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের যদি পেটের ভাত ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় তাহলে, তারা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি আছি। সরকার যেভাবে চাইবে আমরা সংস্কারের জন্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় বলেছি, কোটা পদ্ধতি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি। আমরা বলেছি, বৈষম্য বিরোধী যেকোনো আন্দোলনে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। কোটা পদ্ধতি ছিল সংবিধান পরিপন্থি। কারণ, সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠির জন্য কোটা বরাদ্দের কথা আছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নেই। আওয়ামী লীগ সব সেক্টরেই বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা অংশ নেইনি। ৩০০ প্রার্থীর মধ্যে ২৭০ জন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছে। আমি সরকারের মন্ত্রী থেকেও নির্বাচন বর্জন করেছিলাম। বিএনপি’র দায়ের করা একটি মামলা ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছে। আমার ভাবিকে (রওশন এরশাদ) দিয়ে সরকার জাতীয় পার্টির মধ্যে একটি বিভাজন সৃষ্টি করেছিল। জাতীয় পার্টির সকল সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিনি জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়েছে। মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় পার্টিকে নির্যাতন করেছে। মঞ্জুর হত্যা মামলা দিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ফাঁসির ভয় দেখানো হয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে আমরা বার বার চলে আসতে চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের মিডিয়া এবং সচেতন মানুষ জানে জাতীয় পার্টির গলায় ফাঁস লাগিয়ে নির্বাচনে নিয়েছে আওয়ামীলীগ। আমাদের দলের রাজনীতি করতে দেয়নি স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ।
তিনি বলেন, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমরা আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন অপশন ছিল না। আমাদের দল হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু দলটি বেঁচে গেছে। দল না থাকলে আমাদের রাজনীতি থাকবে না। তাই, দল বাঁচানো আমাদের কাছে জরুরী ছিল। নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরেও আমরা বলেছি, নির্বাচন সঠিক হয়নি। কোন কোন আসনে সরকার কোন হস্তক্ষেপ করেনি। যেমন আমার নির্বাচনী এলাকায়।
তিনি বলেন, অনেক বেশী মামলা হচ্ছে। এতো বেশী মামলা হলে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যাবে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক এই দাবী আমি আগেই করেছি। যা দেশী ও বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং স্বল্প সময়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে আমরা তাতে সন্তোষ প্রকাশ করছি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, এ্যাড. মোঃ রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মোস্তফা আল মাহমুদ, মনিরুল ইসলাম মিলন, মাসরুর মওলা, জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মোঃ খলিলুর রহমান খলিল প্রমুখ।
চাটগাঁ নিউজ/এআইকে