নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্ষা এলেই আতংকের নগরী হয়ে উঠে চট্টগ্রাম। কখন কার মৃত্যু কিভাবে চলে আসে এ ভয়ে পথ চলতে হয় নগরবাসীর। কারণ একটু বৃষ্টি হলেই অরক্ষিত খালগুলো হয়ে উঠে এক একটা মৃত্যুফাঁদ! যে ফাঁদে পড়ে এবার অপমৃত্যুর মিছিলে নাম লেখালো মাত্র ছয় মাসের শিশু সন্তান সেহেরিশ।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাত ৮টায় দাদী আয়েশা ও মা সালমা বেগমের কোলে বসে কাপাসগোলায় ফুফুর বাড়ির যাচ্ছিল শিশু সেহেরিশ। পথিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলে সিএনজি থেকে নেমে গলির ভেতরে ব্যাটারি চালিত রিকশায় ওঠেন তারা। এই ব্যাটারি চালিত রিকশাই যেন কাল হলো তাদের। চোখের সামনেই নিমিষে তলিয়ে গেলো খালে।
জানা গেছে, সেই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাটি গলির ভেতরে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাপাসগোলার নবাব হোটেল সংলগ্ন হিজলা খালে পড়ে যায়। সাথে থাকা মা সালমা ও দাদী আয়েশাকে স্থানীয় ও পথচারীরা দ্রুত টেনে তুললেও খালের হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় মায়ের কোলে পরম যত্নে থাকা শিশু সেহেরিশ। সেই কোল খালি হওয়ার পর থেকেই বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা আয়েশা। আর আক্ষেপের সুরে বিলাপ করে যাচ্ছেন কেন আরেকটু শক্ত করে যক্ষের ধনের মতো সন্তানকে আগলে রাখতে পারলেন না!
নিখোঁজ সেই ৬ মাসের শিশুকে খুঁজতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি প্রশাসন। চসিক, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনীর ডুবুরি দল ও স্থানীয়দের রাতভর চেষ্টা প্রশংসা করার মতোই ছিল। তবে তাদের চেষ্টা খুব বেশি কাজে আসেনি।
আজ শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকালে নিখোঁজের প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আছদগঞ্জের শুঁটকিপট্টির নিজ এলাকার খালে ভেসে উঠে সেহেরিশের নিথর দেহ। এতেই যেন আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টিতে লেগেছে শোকের মাতম।
সরেজমিনে শিশু সেহেরিশের আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়— পুরো শুঁটকিপট্টিতেই বিরাজ করছে থমথমে ভাব। হারিয়ে গেছে শুঁটকিপট্টির সেই চিরচেনা হাঁকডাক।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। দূর্ঘটনার পর থেকে সেহেরিশের পরিবারের পাশে ছিলেন তিনি। তিনি জানান, বেপরোয়া ব্যাটারি চালিত আটোরিকশার কারণেই ঘটেছে এ দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রামে খাল-নালায় পড়ে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গেল চার বছরে বৃষ্টির মৌসুমে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এই সকল অরক্ষিত খালে। গত বছরের জুনেও নালায় পড়ে স্রোতে তলিয়ে যায় সাত বছরের এক শিশু।
২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে বৃষ্টির মধ্যে খোলা নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। দীর্ঘ সময় উদ্ধার অভিযান চালিয়েও তার মরদেহের আর খোঁজ মেলেনি। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া।
এরপর ২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু কামাল। তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকায় দেড় বছর বয়সী শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ১৬ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
এছাড়াও ২০২৪ সালের জুনে আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাদিউল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন নাছির খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ এইবার মায়ের চোখের সামনেই খালের পানিতে তলিয়ে যায় শিশু সেহেরিশ। এর মধ্য দিয়ে নগরবাসী আবারো স্বাক্ষী হলো নতুন এক হৃদয় বিদারক ঘটনার।
আর কতো মৃত্যু দেখতে হবে নগরবাসীকে? এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র শাহাদাত বলেন, নগরীর প্রতিটা খালে ব্যারিয়ার লাগানোর কাজ ইতোমধ্যেই শেষ, যে কয়টা বাকি আছে তাও প্রায় শেষের দিকে। এমন মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের কারণেই খালের পাশের নিরাপত্তাবেষ্টনী খুলে রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
এদিকে আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টি জামে মসজিদে যোহরের নামাজের পর শিশু সেহেরিশের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার দাদার বাড়ি বাকলিয়া সোনামিয়া জামে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
চাটগাঁ নিউজ/এইচএস/জেএইচ