ঈদগাঁও প্রতিনিধি: বনবিভাগের জমিতে সামাজিক বনায়ন ছাড়া কোনো স্থাপনা বা স্থায়ী বসবাসের জন্য বসতবাড়ি করার বিধান নেই। তবুও চকরিয়া উপজেলার হারবাং বনবিটের অধীনে বেশিরভাগ সংরক্ষিত বনভূমির জমি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মিলছে। আর সেই জমিতে আধা-পাকা ঘর বা দালান করতে বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এ কারণে ওই উপজেলায় দিন দিন বন বিভাগের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বনের গাছ কেটে জমি দখল নিয়ে গড়ে তুলছেন ঘর-বাড়ি।
সরেজমিন চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৩, ৬, ৭ ও ৮নং ওয়ার্ডের ইনানী লাগোয়া গুচ্ছ গ্রাম, মসজিদ মোরা, আলীপুর, করমুহুরীপাড়াসহ বেশ কিছু গ্রামে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। চারিদিকে বড় বড় পাহাড়ের টিলা আর সারি সারি গাছ এবং তার ভেতরে নতুন নতুন ঘর-বাড়ি। শতশত নতুন নতুন টিনের ঘর আর দালানে ভরে গেছে পুরো বনভূমির জায়গা। দেখলেই মনে হয় এ যেন নতুন একটি গ্রাম! না,এটি কোন গ্রাম নয়। এটি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনভূমি।
কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে জমিগুলো সামাজিক বনায়নের নামে দখলে নিয়ে সেখানে নির্মাণ করছেন বড়বড় দালান ও আধাপাকা ঘরবাড়ি। এতে করে সামাজিক বনায়নের নাম করে দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে শতশত একর বনভূমি।
হারবাং ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের গুচ্ছগ্রাম এলাকায় বনের ভেতর চোখ যেতেই দেখা যায় নির্মাণাধীন ২টি ইটের তৈরি পাকা ভবন। তৎমধ্যে ১টির সদ্য কাজ শুরু হলেও অন্য একটির কাজ প্রায় শেষের দিকে৷ চলছে বাউন্ডারি নির্মাণের কাজ।
সরেজমিন গিয়ে বাড়িগুলো কারা নির্মাণ করছে জানতে চাইলে বাড়ি নির্মাণে নিয়োজিত এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, সদ্য কাজ শুরু হওয়া বাড়িটি করছেন মো. জিয়াবুল ও কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া বাড়িটি করছেন মোজাম্মেল নামের দুই ব্যক্তি। তারা দুজনই সহোদর ভাই বলে জানা গেছে। এছাড়াও নির্মাণাধীন পাকা বসতবাড়ির অপর পাশে রয়েছে মাটির ঘরসহ একাধিক আধা পাকা ও টিনের ঘর।
অপরদিকে ৬নং ওয়ার্ডের মসজিদ মোরা গ্রামে গেলেও মিলে একই চিত্র। বনবিভাগের আওতাধীন সামাজিক বনায়নের পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে দুইটি বাড়ি। এদের মধ্যে একটি জামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ও অন্যটি মোঃ হামিদ নামের আরেক ব্যক্তি ইটের তৈরি পাকা ভবনগুলো নির্মাণ করছে। এই এলাকাটিতেও সরেজমিন গেলে বাড়িতে অপরিচিত লোক এসেছেন দেখে এগিয়ে আসেন এক নারী। বাড়িটি কার জিজ্ঞেস করলেই উত্তরে তিনি জানান, বাড়িটি তাদের। তার স্বামীর নাম মো. হামিদ। বন বিভাগের জায়গায় ঘর তুলছেন কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, বিট কর্মকর্তাকে বলে বাড়ি নিমার্ণ করতেছি। তাই এই জমিটি রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বনকর্মীদের ম্যানেজ করে নেওয়া হয়েছে। তা না হলেতো ঘর তুলতে দেয় না। এসময় সাংবাদিকরা বনবিভাগের জায়গাতে কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করার এখতিয়ার না থাকা স্বত্ত্বেও কেন বনবিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে সেখানে বাড়ি নির্মাণ করছেন, এমন প্রশ্ন করলে তিনি সাংবাদিকদের কর্কশ কণ্ঠে বলেন, এ এলাকাতে পাকা, আধা পাকা ও টিনের অন্তত ৫০/১০০টির অধিক বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এসময়তো এমন কোন প্রশ্ন আসেনি আমার বেলায় কেন এতো প্রশ্ন এবং এতো আইন? আমি আপনাদের এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমি বনবিভাগকে ম্যানেজ করেই বাড়ি নির্মাণ করতেছি। তাই এখানে এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
তিনি এসময় আরো বলেন, আমার বেলায় যদি এতো প্রশ্ন এবং আইনের প্রসঙ্গ আসে তাহলে অন্যদের বেলায় কেন তা নয়? এমন আইন যদি থেকে থাকে তাহলে সবার জন্য তা সমান হতে হবে। তার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে চলে আসে তার স্বামী। তিনি এসেই সাংবাদিকদের পরিচয় জানতে চাইলে পরিচয় দেওয়া হয় এবং পরক্ষণেই তিনি কথা বার্তায় কৌশল অবলম্বন করে বলেন, আমরা গরীব মানুষ। জীবন যাপনের জন্য একটি বসতবাড়ির দরকার। তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ৩কেজি বিন্নি চাউল ও ১টি দেশি মোরগ দিয়ে জায়গাটির অনুমোদন নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করছি।
এছাড়াও অপর আরেক ব্যক্তি জামাল উদ্দিন ও বলেন একই কথা। তার দাবী সেও রেঞ্জ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বনবিভাগের পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করছে এবং এরকম শত শত বাড়ি এখানে করা হয়েছে। অন্যদিকে তাদের এমন কথার ভিত্তিতে সাংবাদিকরা সরেজমিন এলাকাটি ঘুরে দেখতে পায়, বনবিভাগের জমি দখল করে জামাল ও হামিদের স্ত্রীর কথা মতো ৫০/১০০টির অধিক পাকা, আধা পাকা ও টিনের বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এবং এসব বাড়ি নির্মাণ করতে কাটা হয়েছে পাহাড়ের টিলা ও বনজ এবং ফলজ গাছপালা। অপরদিকে ৭ ও ৮ নং ওয়ার্ডের চিত্রও একই।
৭নং ওয়ার্ডের আলীপুর এলাকার মোঃ আনিস নামের ব্যক্তি নির্মাণ করছে বসতবাড়ি। ৮নং ওয়ার্ডের করমুহুরীপাড়া এলাকার খোরশেদ আলমও সদ্য নির্মাণ শেষ করেছেন একটি আধা পাকা বাড়ির। চলছে দরজা-জানালা লাগানোর কাজ। সেখানেও সরজমিন গেলে খোরশেদ আলমের স্ত্রী বলেন, তার মামা ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার ছৈয়দ নুরের মাধ্যমে রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বনকর্মীদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই বাড়িটি নির্মাণ করছেন।
অপরদিকে এসব এলাকা ঘুরতে ঘুরতে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে এভাবেই সরকারি জমি প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন। আবার সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণও করছেন। এভাবে চলতে থাকলে পুরো বন উজাড় হয়ে যাবে।
ম্যানেজ হয়ে বনভূমি দখল করতে দেওয়ার বিষয়ে চুনতি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আবু জাকারিয়া বলেন, কোন বনভূমি দখলবাজকে বনভূমিতে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ হয়ে বাড়ি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে, আপনার দেওয়া তথ্যমতে সমুহ জায়গায় অভিযান চালানো হবে। আর ৮ নং ওয়ার্ডের করমুহুরীপাড়া এলাকার খোরশেদের বাড়ির ব্যাপারে মামলা পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন এর সাথে এবিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।