আনোয়ারা প্রতিনিধি : কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত স্বপ্নের টানেল চালুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলছে না। ফলে আয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় এখন পর্যন্ত বেশি। তবে দীর্ঘ মেয়াদী এ প্রকল্পে সব পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন না হওয়া পর্যন্ত লোকসান প্রকল্প বলা যাবে না বলে জানিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ। টানেলের সুফল পেতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।
জানা গেছে, গত এক বছরে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। এরমধ্যে প্রাইভেট কার, হাইস (লাইট গাড়ি) চলাচল করেছে ৭৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বাস ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ দশমিক ৪ শতাংশ ও ট্রেইলর দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) পর্যন্ত টানেল দিয়ে দৈনিক গড়ে যানবাহন চলাচল করেছে ৩ হাজার ৯১০টি। এতে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হয়েছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৪ টাকা। এক বছরে টোল আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬১ হাজার ২১০ টাকা।
অন্যদিকে, এই টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দৈনিক ব্যয় গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৩ টাকা। কর্তৃপক্ষের দৈনিক লোকসান ২৭ লাখ ৯ হাজার ৮৩৯ টাকা। সে হিসাবে এক বছরে লোকসান ৯৮ কোটি ৯০ লাখ ১ হাজার ২৩৫ টাকা।
গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে টানেলের সার্বিক বিষয় দেখতে পরিদর্শনে আসেন সেতু বিভাগের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। তিনি টানেল রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বরর্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে টানেলের গতি বাড়াতে প্রাইভেট গাড়ির টোল অর্ধেক করা, থ্রি হুইলার চালু করা যায় কিনা এসব বিষয়ে আলোচনা হলেও সার্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তা সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। বৈঠকে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে চায়না ইকোনমিক জোন ও বিকল্প সড়ক চালু না হওয়াকে গাড়ি কম চলাচলের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
টানেলের উপ-প্রকল্প পরিচালক (কারিগরি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘টানেল একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প, এখানে সব পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটাকে লোকসান প্রকল্প বলা যাবেনা। এ প্রকল্পের সাথে মেরিনড্রাইভ, চায়না অর্থনৈতিক জোন, আনোয়ারা-বাঁশখালী-কক্সবাজার সড়ক এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম আনোয়ারা-কর্ণফুলী প্রান্তে স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কিছু বাস্তবায়ন হলে এই টানেল দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখবে। টানেলের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের ৫৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্বে রয়েছে। টানেলের সুফল পেতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তিনি।
সূত্রে জানা যায়, প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার টানেলটি নির্মাণ করেছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা। কিন্তু টানেলের এক প্রান্তে সড়ক প্রশস্ত না করা, টানেল কেন্দ্রীক শিল্পায়নের কাজ থেমে যাওয়াসহ টানেল থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিকল্প সড়ক না করায় টানেলের ব্যবহার বাড়ছে না। এতে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-এর মডেলে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল পরবর্তীতে বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে আনোয়ারা প্রান্তে টানেল কেন্দ্রীক গড়ে উঠা ৭টি ব্যাংকের শাখা, বিভিন্ন মার্কেট ও শতাধিক দোকানপাট এখন লোকসানের মুখে এবং অনেকে এখন ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। গত এক বছর আগে যেসব জমি গন্ডা ১৫ থেকে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন সে জমির দাম কমেছে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
স্থানীয় বৈরাগের বাসিন্দা মো. মহিন উদ্দিন বলেন, টানেলের কারণে হঠাৎ জমি দাম বেড়েছে অনেক গুণ। অনেকেই কোটি টাকার পুঁজি দিয়ে গড়েছেন দোকানপাট। এখন বেচাবিক্রি বা ক্রেতা কোনোটায় নেই। সকলে লোকসান গুনছে।’
চাতরী চৌমুহনীর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি শাখার এসপিও এন্ড ইনচার্জ সাইফুদ্দিন মো. শাহিনশাহ্ বলেন, ‘টানেল ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প ধীরগতির কারণে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আমরা লোকসানের সম্মুখিন হচ্ছি।’
টানেল নির্মাণের আগে করা সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, চালুর প্রথম বছর প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলবে ১৭ হাজারের বেশি। কিন্তু গত মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৯১০টি যানবাহন এ টানেল ব্যবহার করেছে। মূলত সমীক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় এ অবস্থা। তবে কক্সবাজার ও মাতারবাড়িকে টানেলের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করার বিষয়ে কাজ চলছে। এটা সম্ভব হলে যানবাহন চলাচল এবং আয় বাড়বে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়।
চাটগাঁ নিউজ/সাজ্জাদ/এসএ