যে কারণে সুনাম হারাচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলো!

উজ্জ্বল দত্ত : বাসি, পচা খাবার, খাবারে পোকা, ফ্রোজেন খাবার, ভেজালসহ নানা অভিযোগে চট্টগ্রামের রেস্টুরেন্টগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। এতে করে ক্রেতা সাধারণের মধ্যে রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে।আবার অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নানা রোগের শিকার হচ্ছেন ক্রেতা সাধারণ। ফলে উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সুনাম হারাচ্ছে নগরীর অনেক রেস্টুরেন্ট। দিন যতই যাচ্ছে রেস্টুরেন্ট মালিকদের অনেকেই ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

বছর পাঁচেক আগেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর হিসেবে পরিচিত ছিল। আভিজাত্য, মানসম্পন্ন ও মুখরোচক খাবারের জন্য সব শ্রেণির রসনা বিলাসী মানুষের পছন্দের জায়গা ছিল রেস্টুরেন্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে উদ্ভুত নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সচেতন ক্রেতাদের মাঝে অনীহা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কথা বলে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নানা সংকট ও সমস্যার কথা জানা গেছে। তা তুলে ধরা হলো-

অভিযানের ফলোআপ নেই

মানদণ্ড ঠিক করতে জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। তবে ক্রেতা সাধারণের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও তা যথেষ্ট নয়। আবার যেখানে অভিযান চালানো হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে কোন ফলো আপ করা হয় না। ফলো আপ না থাকার কারণে রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের গুণগত মান অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।

জনবল ও সমন্বয়ের অভাব

অভিযান পরিচালনা করতে হলে প্রয়োজনীয় জনবল দরকার। তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, টাস্ক ফোর্স বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাছাড়া অভিযান পরিচালনায় জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, টাস্কফোর্স বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে দৃশ্যমান কোন সমন্বয় নেই। ফলে একদিকে অভিযান চললে অভিযুক্তরা অন্যদিক দিয়ে পার পেয়ে যায়। অভিযান নিয়ে প্রশাসনের সাথে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের যেন ইঁদুর বিড়াল খেলা চলে।

এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন চাটগাঁ নিউজকে বলেন, প্রশাসনকে রুটিন ওয়ার্ক করার পাশাপাশি ফলোআপে নজর দিতে হবে। রেস্টুরেন্টগুলোতে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূরক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি। সমন্বিত ভাবেই মান নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে কমছে ক্রেতা 

বর্তমান মুদ্রাষ্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রেস্টুরেন্ট খাবারের দামও বৃদ্ধি করা হয়েছে। উচ্চমূ্ল্যের কারণে ক্রেতা সাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে দৈনন্দিন ব্যয় বাজেট। ফলে রেস্টুরেন্টগুলোতে ক্রেতার উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো খাতের উপর।

এ বিষয়ে নগরীর ওয়াসা মোড়স্থ কাচ্চি ভাই’র ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ বাশার চাটগাঁ নিউজকে বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। সেই হিসেবে আমরা প্রোডাক্টের মূল্য তেমন বাড়াতে পারিনি। আবার কাস্টমার অনেক কমে গেছে। পুরো চাপ পড়ছে রেস্টুরেন্টের ওপর। কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ভাতাসহ সব ব্যয় নির্বাহ করার পর মুনাফা করা কঠিন হয়ে গেছে।

খাবারের মান রক্ষায় মালিক-কর্মচারীর দ্বিমত 

রেস্টুরেন্টে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্ট কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তবে প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের লব্ধ প্রশিক্ষণ জ্ঞান ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজে লাগায় কিনা তা মনিটরিংয়ের কোন উদ্যোগ নেই। আবার খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে রেস্টুরেন্ট মালিক পক্ষ ও শেফ-বাবুর্চিদের মধ্যে দ্বিমত হয়ে থাকে। খাবারকে মজাদার ও মানসম্পন্ন করতে শেফ-কর্মচারীরা রেসিপির প্রয়োজনীয় উপকরণ সমেত খাবার প্রস্তুত করতে চায়। কিন্তু মালিক পক্ষের অনেকেই বেশি মুনাফার জন্য খাবার তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ মেশাতে চান না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মালিক পক্ষ চাইলেও অসচেতন কর্মচারীরা অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে খাবার তৈরি করে ফেলে।এতে খাবারের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। আর মান নষ্ট হয়ে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেন।

শনিবার সন্ধ্যায় সাপ্তাহিক ছুটিতে ব্যাংকার মোহাম্মদ মোত্তাকিম তার স্ত্রীকে নিয়ে বিরিয়ানি খেতে নগরীর কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে এসেছেন। তিনি জানান, আগে প্রতি সপ্তাহেই স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে আসতাম। কিন্তু এখন প্রায় সময় রেস্টুরেন্টগুলোতে ভেজাল, বাসি, মেয়াদোত্তীর্ণ, নোংরা খাবার বিক্রির অভিযোগ শোনা যায়। আমরা আসলেই জানি না টাকা দিয়ে কি খাচ্ছি? তাই ইদানিং বাইরের খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।

সংরক্ষণে ঘাপলা 

খাবার দীর্ঘসময় সংরক্ষণের ফলে গুণমান নষ্ট হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টগুলোতে দেখা যায়, শ্রম ও সময় বাঁচাতে শেফ-কর্মচারীরা ভেজে রাখা মাছ-মাংস, বিক্রি না হওয়া খাবার ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রেখে দেন। ফ্রিজে খাবার দীর্ঘ সময় সংরক্ষিত থাকলে তাতে সিএফসি গ্যাস সংক্রমিত হয়। যা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ভোক্তা অধিকারের নিয়মিত অভিযান চলমান আছে। শুরু থেকেই আমরা মাঠে ছিলাম। হোটেল, রেস্টুরেন্টে অভিযান নিয়মিত করা হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন অনিয়মে জরিমানার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ব্যবসায়ীদের সর্তকও করা হচ্ছে। মান নিয়ন্ত্রণে সবার সমন্বিত সহযোগিতা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি আইনকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা থাকাও জরুরি ।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top