নিজস্ব প্রতিবেদক : বাজারে আড়াইশ-তিনশ টাকার কমে মিলছে না কোনো বিদেশি ফল। মুসম্বি, মাল্টা, আঙ্গুর, কমলা, আপেলসহ আমদানি করা সব ফলই বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে। অথচ দেশীয় সবুজ মাল্টার কেজি মাত্র ৭০ টাকা। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের আগ্রহ ও স্বস্তি বাড়ছে দেশি ফলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাড়তি দামের কারণে বাজারে বিদেশি ফলের চাহিদা কমে যাচ্ছে। আর চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিও কমে যাচ্ছে। আবার দুর্মূল্যের বাজারে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল থেকে মুখ ফিরিয়ে দেশি ফলে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন ক্রেতা সাধারণ। ফলে কৃষকদের মাঝে ফল চাষ নিয়ে আগ্রহ ও নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে।
আমদানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফল আমদানি দিন দিন কমে যাচ্ছে। ডলার সংকট সৃষ্টির পর ২০২২ সালের ২৩ মে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছিল এনবিআর। আমদানিতে নিরুসাহিত করার লক্ষ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ফল আমদানিতে ব্যাংক ঋণ সুবিধা। বর্তমানে নগদ টাকায় ফল আমদানি করতে হচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই আমদানি করা ফলের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয় ৮ লাখ ২২ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু আপেল আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন। একই সময়ে মাল্টা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার টন।
গত অর্থবছরে দেশে আঙ্গুর আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টন। কমলা আমদানি হয়েছে ৬৯ হাজার টন।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। চীন, থাইল্যান্ড, ভুটান, মিসর, ব্রাজিল, তিউনিসিয়া, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফল আমদানি করা হয়।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, বছরের জুলাই মাসে ফল আমদানি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫৩ মেট্রিক টন, আগস্ট মাসে আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৯৩ মেট্রিক টন। জুলাই মাসে আমদানি হওয়া ফলের মধ্যে আপেল ছয় হাজার ৬০০ মেট্রিক টন, কমলা ও মাল্টা ৭ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন, আঙ্গুর দুই হাজার ৬৮০ মেট্রিক টন, নাশপাতি ১৪৮ মেট্রিক টন। আগস্ট মাসে আমদানি হওয়া ফলের মধ্যে রয়েছে আপেল ৬ হাজার ৪৫২ মেট্রিক টন, কমলা ও মাল্টা ৮ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন, আঙ্গুর দুই হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন এবং নাশপাতি ৪২৩ মেট্রিক টন।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বিদেশি ফল আমদানি আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। ডলার সংকট, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এমনটা হয়েছে। তাছাড়া চাহিদা কমার কারণেও আমদানি কমে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের ফলমণ্ডি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ফল আমদানিকারক তৌহিদুল আলম চাটগাঁ নিউজকে বলেন, একদিকে এখন ফলের মৌসুম নয়, তারওপর ডলারের দামবৃদ্ধি এবং বন্দরের ডিউটি ফি বেশি হওয়ার কারণে বিদেশি ফলের দাম এখন বাড়তি। আগে ১০০ টাকা দিয়ে মাল্টা পাওয়া যেতো, কিন্তু গত এক বছর আগে এসব বিদেশি ফল অভিজাত পণ্য ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করায় কেজিতে ১০০ টাকা করে বেড়েছে। তাই ডিউটি কমালে দাম অনেকটা কমে আসতো।
তিনি জানান, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারসহ সারা পৃথিবীতে এখন ফলের মৌসুম নেই। আফ্রিকার কিছু গুদামে ফল রয়েছে, সেগুলো চড়া দামে আমদানি করতে হচ্ছে। আবার বর্তমানে শুধু আপেলের মৌসুম চলছে। সেটাও সরবরাহ কম। আবার দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে লেনদেন বা ঋণপত্র খোলা (এলসি) করা যাচ্ছে না। এর প্রভাবও আমদানিতে পড়েছে।
নগরীর আন্দরকিল্লা, মোমিন রোড, কোতোয়ালি মোড়স্থ সড়ক এলাকা সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদেশি মাল্টার কেজি ২৫০ টাকা, আঙ্গুর ৩০০ টাকা, আপেল ২৬০-২৮০টাকা, কমলা ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ দেশীয় সবুজ মাল্টার কেজি মাত্র ৭০ টাকা। সিলেটি জাম্বুরা সাইজ ভেদে প্রতি পিস ৬০-৮০ টাকা, ড্রাগন কেজি ১৫০-১৭০ টাকা, ছোট বড় ৯০-১২০ টাকা ডজনে
চাঁপা কলা এবং ৬০-৭০ টাকা ডজনে চাম্পা কলা বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতারা বিদেশি ফলের চেয়ে দেশীয় ফলেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ গেইটের ফল বিক্রেতা মো. সেলিম জানান, বিদেশি ফলে এখন পোষাতে পারছি না। লাভ কম। পরতায় মিলাতে পারছি না। আবার বিক্রিও কম। এক ক্যারেট মাল্টা আনলে এক সপ্তাহেও বিক্রি করতে পারছি না। তার চেয়ে দেশীয় ফলের বেচা ভাল।
মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আন্দরকিল্লা এলাকা থেকে ১০০ টাকায় প্রায় দেড় কেজি সবুজ মাল্টা কিনে নিয়েছেন মো. হারুণ।
তিনি বলেন, কেজি ৭০ টাকা। অনেক ভাল। সিজনের নতুন চালান। হালকা টক। আপনার বিদেশি মাল্টাও তেমন মিষ্টি নয়, মোটামুটি। কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকা। বিদেশি ফল কয় মাস আগে গাছ থেকে পাড়া হয়েছে কেউ জানে না। তার চেয়ে দেশীয় ফ্রেশ ফল অনেক ভাল।
চাটগাঁ নিউজ/ উজ্জ্বল/এসএ